নির্বাচিত জেলা ক্রীড়া সংস্থাই জেলা পর্যায়ে খেলাধুলা সচল রাখে। অথচ ১৪ বছর ধরে কিশোরগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা পরিচালিত হচ্ছে অ্যাডহক কমিটি দিয়ে। এতে করে অচল হয়ে পড়েছে কিশোরগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গন।
জানা গেছে, কিশোরগঞ্জে মোট ৬১টি ক্রীড়া সংগঠন রয়েছে। বেশির ভাগ সংগঠন মনে করে, অ্যাডহক কমিটি দিয়ে জেলার ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনা ঠিকঠাক সম্ভব নয়। নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া কিশোরগঞ্জের ক্রীড়াঙ্গন প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সরকার জেলা ক্রীড়া সংস্থাগুলো ভেঙে দিয়েছে। তবে অদৃশ্য কারণে নির্বাচন আয়োজনে ‘ধীরে চলো’ নীতি অবলম্বন করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ লিগসহ ফুটবল, ক্রিকেটের পাশাপাশি সব ক্ষেত্রেই অচলাবস্থা বিরাজ করছে। জেলা শহরের দুটি স্টেডিয়ামের মধ্যে পুরোনো স্টেডিয়ামে বিভিন্ন ধরনের মেলা, রাজনৈতিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আর সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলার আয়োজন করা হয় কালেভদ্রে। নিয়মিত খেলা না হওয়ায় অনিশ্চিত হতাশায় খেলোয়াড়, সংগঠকসহ ক্রীড়াসংশ্লিষ্টদের মধ্যে চরম হতাশা ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। তরুণ ক্রীড়াবিদেরা তাঁদের ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
ক্রীড়া সংগঠনের নেতারা বলছেন, গত ১৪ বছরের মধ্যে জেলা ক্রীড়া সংস্থার ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগ ২০১৮, ২০২১ ও ২০২৩ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে ২০২৩ সালে আয়োজিত প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগের ফাইনাল খেলা এখনো হয়নি। ২০১৮ ও ২০২০ সালে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেট লিগের আয়োজন করে জেলা ক্রীড়া সংস্থা। ভলিবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়েছিল ২০২২ সালে। এ ছাড়া আর কোনো প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়নি। অ্যাডহক কমিটির মূল দায়িত্ব দ্রুততম সময়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে সর্বশেষ জেলা ক্রীড়া সংস্থার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এম এ বারী খান। ২০১১ সালের ২১ জুলাই জেলা ক্রীড়া সংস্থার কমিটির মেয়াদ শেষ হয়। গঠনতন্ত্র মোতাবেক মেয়াদ শেষ হওয়ার এক মাস পূর্বেই নতুন কমিটি গঠনের জন্য নির্বাচনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। ওই বছর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী নেতাদের হস্তক্ষেপে ১৫ সদস্যের একটি অ্যাডহক কমিটি গঠন করা হয়।
অ্যাডহক কমিটি ৯০ দিনের মধ্যে নতুন কার্যনির্বাহী পরিষদ নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করাসহ দায়িত্ব হস্তান্তর করতে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের নির্দেশনা থাকলেও ওই কমিটি বিভিন্ন টালবাহানা করে ১২ বছর কাটিয়ে দেয়। গত বছর আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২১ আগস্ট যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে কিশোরগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থার অ্যাডহক কমিটি ভেঙে দেওয়ার নির্দেশনা দেয়। পরে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ গত ২৭ মার্চ ৯ সদস্যবিশিষ্ট একটি নতুন অ্যাডহক কমিটি গঠন করে। এই কমিটি ৯০ দিন পেরিয়ে গেলেও নির্বাচন আয়োজনের কোনো ব্যবস্থা এখনো নিতে পারেনি।
কিশোরগঞ্জ জেলা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক রেদুয়ান হোসেন সিয়াম বলেন, আমরা প্রফেশনাল ক্রিকেটার। আমরা কয়েকজন ঢাকায় লীগ খেলি। ওইখান থেকে যে টাকা পাই তা দিয়েই চলি। কিশোরগঞ্জে যদি খেলা না হয় তবে প্রফেশনাল ক্রিকেট চালাতে কস্ট হয়ে যায়। লীগ হয় না অনেক বছর ধরে। ৩ বছর আগে প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লীগ হয়েছিলো। তারপরে আর লীগ হয় নাই। আমরা সারা বছর অনুশীলন করতে পারি না। মাঠের যে অবস্থা! বৃষ্টির সময় মাঠের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। আমরা যদি সারাবছর অনুশীলন করতে না পারি তাহলে আমাদের ক্ষতি হয়।
তিনি বলেন, বৃষ্টি হলেই মাঠের ঘাস বড় হয়ে যায়। ঘাস কাটা হয় না৷ আমরা দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের জানিয়েছি বিষয়টা তবে ওরা কবে নাগাদ ঠিক করবে তা জানি না। ক্রিকেটের জন্য যদি ভালো কিছু চান তাহলে লীগ দিতে হবে এবং মাঠ খেলার উপযুক্ত করতে হবে। নাহয় কিশোরগঞ্জ থেকে ক্রিকেটের ভালো হবে না। আমাদের অনুশীলন করার মাঠ একটাই। নজরুল ইসলাম স্টেডিয়ামে সাইড কোনো উইকেট নাই। তিনটা উইকেট আছে ওইগুলোর মানও ভালো না। একটা কনক্রিট আছে ওইখানে বৃষ্টি হলেই অনুশীলন করা যায় না। ঘাসের মধ্যে মাঠে নামা যায় না। অন্যান্য জেলায় ইনডোর আছে। আমাদের নাই। ইনডোর হলে সারাবছর অনুশীলন করতে পারতাম।
সাবেক ক্রীড়াবিদ রাকিব মাহবুব বলেন, পুরাতন স্টেডিয়ামে একসময় ক্রিকেট ও ফুটবল লীগ হতো। কিন্তু ক্রীড়া সংস্থা এবং ফুটবল এসোসিয়েশনের অনাগ্রহে কোনো খেলারই আয়োজন হয় না। এই মাঠ হয়ে গেছে সকল রাজনৈতিক দলের সভাসমাবেশ করার মাঠ। ক্রীড়াঙ্গনকে বাঁচাতে দ্রুত ক্রীড়া সংস্থার ও ফুটবল এসোসিয়েশনের নির্বাচনের দাবি জানাই।
ইংলিশ এন্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক কর্মকর্তা ও সম্ভাব্য সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী বীর মুক্তিযোদ্ধা সারোয়ার মুর্শেদ খান স্মৃতি সংসদের সভাপতি মোহাম্মদ সায়েদুল বাশার খান সায়েম বলেন, আমি যদি এক কথায় বলি, কিশোরগঞ্জ জেলা ক্রীড়া সংস্থা একটি অভিভাবকহীন ক্রীড়া সংস্হায় পরিনত হয়েছে। কারন বিগত চৌদ্দ বছর যাবত নির্বাচিত কোন কমিটি নাই। গত এক যুগ আগে তিন মাসের জন্য গঠিত অ্যাডহক কমিটি বারো বছরেও কোন নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে নাই। বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের আমলে বিভিন্ন তালবাহানা করে সময় ক্ষেপন করে ঐতিহ্যবাহী এই ক্রীড়া সংস্হাটিকে তাদের নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ধ্বংসের দারপ্রান্তে নিয়ে যায়। তাই ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিমজ্জিত এই ক্রীড়া সংস্হাটিকে বাঁচাতে জরুরি ভিত্তিতে একটি স্বচ্ছ নির্বাচন সময়ের দাবি!
নব দিগন্ত ক্রিকেট ক্লাবের পরিচালক, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক সৈয়দ এনামুল হক উমর বলেন, আমরা বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হওয়া স্বত্ত্বেও বারবার চেষ্টা করেছি একটি অর্থবহ নির্বাচনের কিন্তু ফ্যাসিষ্ট সরকারের ছত্রছায়ায় গঠিত অ্যাডহক কমিটি তাদের প্রশাসনিক শক্তি দ্বারা ক্রীড়া সংস্হার ধারাবাহিক কার্যক্রম ও উন্নয়নকে দমিয়ে রেখেছে এবং ক্রীড়া সংস্হার উন্নয়ন ও এটিকে বেগবান করার ক্ষেত্রে আমাদের বিভিন্ন উদ্যোগ ও দাবিদাওয়াকে এরা সবসময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে!
সবুজ ভুইয়া স্মৃতি সংসদের সভাপতি, বিশিষ্ট স্কলার, ক্রীড়াবিদ ও সংগঠক মুহাম্মাদ আল মাসুম বলেন: একটি সুস্থ, সুন্দর ও বিকশিত সমাজ বিনির্মানে ক্রীড়াঙ্গনের রয়েছে অপরিসীম ভুমিকা, কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের কিশোরগঞ্জ ক্রীড়াসংস্হা এর ব্যতিক্রম, কারন বিগত বারো বছর যাবত সুস্থ সমাজ বিনির্মানে ক্রীড়া সংস্হার বিশেষ কোন কার্যক্রম কিশোরগন্জবাসীর সামনে পরিলক্ষিত হয়নি! তাই ক্রীড়া সংস্হাটি যেন সমাজ বিকাশে অবদান রাখতে পারে,সে লক্ষ্যে কিশোরগন্জবাসী সত ও দুর্নীতি মুক্ত নতুন তরুণ নেতৃত্ব কামনা করছে!!
জেলা ক্রীড়া সংস্থার আহবায়ক ও জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান বলেন, জেলা ক্রীড়া সংস্থার নীতিমালা অনুযায়ী নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
Comments
comments