কামাল লোহানী ছিলেন বাঙ্গালির ইতিহাসের সাক্ষী। লোহানীর কণ্ঠে বাঙ্গালি জাতি প্রথম জেনেছিলো বিজয়ের কথা। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতারে লোহানীর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিলো “আমরা বিজয় অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছে।” খুব সংক্ষিপ্ত লোহানীর এই কথায় বিজয় উল্লাসে মেতেছিলেন গোটা দেশ।
সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, সংগঠক এমন যেকোনো পরিচয়ে সংঙ্গায়িত করা যায় কামাল লোহানী’কে। তিনি সেসময় ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগের প্রধান। এছাড়াও তিনি উদীচী, ছায়ানটের মতো অন্যান্য জায়গায় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেন। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন জন্মগ্রহণ করেছিলেন কামাল লোহানী। ১৯৫২ সালে তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। পরে পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন।
কামাল লোহানী একজন ভাষা সৈনিক। তিনি পাবনা জিলা স্কুলে ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। আর এর মাধ্যমেই তিনি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। মুসলিম লীগ নেতাদের পাবনা আগমন প্রতিরোধ করতে গিয়ে ১৯৫৩ সালে তিনি কারাগারে যান তিনি। সেখান থেকে মুক্ত হতে না হতেই ১৯৫৪ সালে বাম রাজনীতির সঙ্গে যোগ দেন।
সেই সময়ের কারাগারগুলো ছিল একধরনের শিক্ষায়তন। বড় বড় সব নেতা জেলখানায় বন্দী থাকতেন রাজনীতির কারণে। অনেকেই ওই সময়ের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন বাম-ডান নেতার মধ্যে আদর্শগত পার্থক্য থাকলেও জীবনাচরণে তাদের কোনো তফাৎ ছিল না। বাম রাজনীতিতে যোগদানের পরে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে ১৯৫৪ সালে কাজ করার সময় আবার গ্রেপ্তার হন তিনি। জেলে যান লোহানী। সেই জেলে বন্দী ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজ উদ্দিন আহমেদসহ আরও কিছু নেতা। তাদের সঙ্গে বন্দী জীবন কাটান কামাল লোহানী।
এ সময় রাজনীতি ও সংস্কৃতি একসঙ্গে দুটোই যেন তাকে গ্রাস করে নিয়েছে। যার ফলে পরের বার গ্রেপ্তার হয়ে ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে মুক্তি পাবার পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে পুরোপুরি রাজনীতি শুরু করেন। রাজনীতি করলেও তিনি আপাদমস্তক একজন সাংস্কৃতিক ও সাংগঠনিক মানুষ ছিলেন। তিনি রাশভারী ভরাট মসৃণ কণ্ঠে যখন কথা বলতেন তখন তা শুনে মনে হতে পারে, এ ধরনের কণ্ঠ আছে বলেই বাংলা ভাষার মাধুর্য নিয়ে গর্ব করা হয়। এমনই মাধুর্য ছিলো লোহানীর কণ্ঠে।
কামাল লোহানী বাম রাজনীতি করার সময় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কাগমারী সম্মেলনে অংশ নেন। অন্যদিকে আইয়ুব খানের মার্শাল লর সময়েও তিনি রাজনৈতিক কারণে কারাগারে বন্দী ছিলেন। সে-সময়ে কারাগারে বন্দী অনেক সিনিয়র নেতাদের কাছ থেকে তরুণরা রাজনীতি শিখতেন, জীবনের শৃঙ্খলা গণ চরিত্র কী করে অর্জন করতে হয়, সেসব শেখাতেন। এভাবে সর্বোপরি একটা স্বপ্ন গড়ে উঠত। সেই স্বপ্নের তাড়নায় তাদের বাকি জীবন চলতেন। লোহানীর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
লোহানী তাঁর জীবনের প্রতিটি ধাপে পূর্ণ গভীরতা নিয়ে কাজ করে গেছেন তিনি। নাট্যকার মামুনুর রশিদ লিখেছেন, “এমন একজন মানুষ এখন খুঁজে পাওয়া সত্যিই মুশকিল, যিনি আছেন শ্রদ্ধার জায়গায়, বন্ধুর জায়গায়। ষাটের দশকে যখন আমরা শিল্পের বারান্দায় ঘোরাঘুরি করছি, তখন কামাল লোহানীকে দেখেছি দূর থেকে, দুর্দান্ত তাঁর অগ্নিঝরা বক্তৃতা, অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তি এবং সেই সঙ্গে কৃষক শ্রমিকের হাহাকার নিয়ে নৃত্যনাট্য। সেই নৃত্যনাট্যে প্রবীণ শিল্পী কামাল লোহানী।”
তিনি সারাজীবন নির্লোভ জীবন কাটিয়েছেন। কামাল লোহানী সংস্কৃতি, রাজনীতি ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে পূর্ণতায় অবগাহন করেছেন। তিনি গণসংগীত ও গণসংস্কৃতিকে সঙ্গী করে চারণের বেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা দেশে। এতে সংসার জীবনে এতোটা দায়িত্ব হয়তো তিনি পালন করতে পারেননি। যার পুরোটা পালন করে নিরবে তাকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন তার সহধর্মিণী। আর এজন্যই হয়তো তিনি তার সহধর্মিণী দীপ্তি লোহানীর লাশের সামনে বুকে হাত জড়ো করে বিষণ্নতার প্রতিমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে বলেছিলেন, “এই ভদ্রমহিলাকে কিছুই দেবার সাধ্য ছিল না, মন ছাড়া।”
কামাল লোহানীর কণ্ঠে কখনো কোনো দুর্বলতাই প্রকাশ পায়নি। তার জন্ম হয়েছিল যেন আঁধার দূর করার জন্য। আজ তিনি নেই একবছর হলো। ২০২০ সালের ২০ জুন তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। তবুও যেন তিনি আলোর পথে ডাকছে আমাদের। মামুনুর রশীদের কথা স্মরণ করে বলতে হয়, “সেই চোখজোড়া এখনো আহ্বান করছে আবারও মানুষকে। বলছে মানুষ তুমি জাগো, তুমি সত্যের ঝান্ডাকে তুলে ধরো। একা নয়, সবাই মিলে আসো।” কামাল লোহানী তার সৃষ্ট পথ আর কর্মের মাধ্যমে বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে।
লেখকঃ রাজীব বাবু
শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী,
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।
Comments
comments