ঢাকাসোমবার , ১৩ এপ্রিল ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. আন্তর্জাতিক
  3. খেলাধুলা
  4. দেশজুড়ে
  5. পজিটিভ বাংলাদেশ
  6. ফটো গ্যালারি
  7. ফিচার
  8. বিনোদন
  9. ভিডিও গ্যালারি
  10. সারাদেশ
  11. সাহিত্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

চোরের দেশ

প্রতিবেদক
Kolom 24
এপ্রিল ১৩, ২০২০ ৬:৪৮ অপরাহ্ণ
Link Copied!

একটি ভয়ঙ্কর কথা বলতে ইচ্ছে করছে, জানিনা কথাটা বলা সমীচীন হচ্ছে কী না! বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং জনগণ নিজেও একে অপরকে চুরি করতে উৎসাহিত করে! সামাজিক আন্দোলন, সাংবিধানিক ব্যবস্থা সকল কিছু এই চুরি ঠেকাতে ব্যর্থ কারণ আমাদের মাথাটা চুরির চিন্তায় সারাক্ষণ নিমগ্ন। বাংলাদেশে এমন কোনো সেক্টর নেই  সেখানে চুরি হচ্ছে না। আপনি একটু চোখ খুলুন সামনে এগিয়ে দেখুন, যে যেমনে পারছে  চুরি করছে। চুরের তালিকায় যে শুধু ছ্যাচড়া নেতারা আছে তা কিন্তু নয়, নেতাদের সাথে নিয়মিত প্রতিযোগিতা করছে অামলা, পুলিশ, শিক্ষক, ব্যাংকার, স্বাস্থ্য খাতের লোক এবং অাধা শিক্ষিত জনগণও বা শুনলে অবাক হবেন লেখাপড়া মোটেও জানেন না এরকম লোকজনও চুরি করছে। এই চুরিগুলা কিন্তু ব্যক্তিগত চুরি নয়, এরা সবাই রাষ ভাবেই চুরি করছে। আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা এমনভাবে সাজানো যে এদের ধরাটাও মুশকিল।তবে নেতাদের চুরি করার একটা ধরণ থাকে কিন্তু বাকি কারোর চুরি করার কোনো ধরণ নেই। অাবার দেশের সব জনগণ জানে বেশিরভাগ নেতারা চোর কিন্তু বাকিগুলার হাঁড়ির খবর নিয়ে কারো এত শোরগোল নাই। নেতারা চুরি করে আবার তা থেকে কিছুটা খরচও করে কারণ নেতাদের লোকদেখানোর জন্য হলেও জনগণের পেছনে, নিজের কর্মীর পেছনে খরচ করতে হয় আবার দল ক্ষমতায় না থাকলেও খরচ করতে হয়। কিন্তু বাকি সবাই চুরি করলেও কোনো খরচ নাই! পুরোটাই নিজের ভোগদখলে!

এ দেশে সবথেকে বড় চোর হল প্রকল্প পরিচালক, ইঞ্জিনিয়াররা। দুয়েকজন যে ভালো নেই সেকথা আমি বলব না। তবে তাদের বেশিরভাগই  চুরি বিদ্যায় নেতাদের থেকেও কয়েকশ গুণ উপরে। আমরা কিছুদিন অাগেও পত্রিকায় দেখেছি এক প্রকল্প পরিচালক নারিকেল গাছ, কলা গাছের যে দাম তিনি দেখিয়ে টাকা অাত্বসাৎ করেছেন তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল! তারপর রুপপুরের বালিশ কান্ড, আলোচিত অপরাধী জি কে শামীম কর্তৃক এক ইঞ্জিনিয়ারকে ১৫০০ কোটি টাকা ঘুষ প্রদান, কয়লাখনির দুর্নীতিসহ অারো বিভিন্ন দুর্নীতির কথা অামরা গণমাধ্যমে দেখেছি। এই দুর্নীতিগুলো কিন্তু কোনো নেতা করেনি এগুলা করেছে বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো  প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করে বের হওয়া জাতির মেধাবী সন্তানরা! একজন ঠিকাদারের সাথে অামার অালাপ হয়েছিলো একবার, তিনি বলেছেন,একটা কাজ পেতে হলে প্রথমে নেতাদের  কিছু দিতে হয়, তারপর কাজ করতে গেলে এলাকার পোলাপানরা বিরক্ত করে, রাস্তায় ইট বালু রাখলে এলাকার মানুষজন ইট বালু চুরি করে সেগুলা ট্যাকেল দেয়া মারাত্মক ব্যাপার অাবার কাজ শেষ করে বিল তুলতে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের উৎকোচ দিতে হয়!  তাহলে আমরা ভালো কাজটা করবো কীভাবে!! সরকার একটা কাজের জন্য যে পরিমাণ বাজেট দেয় তা যথেষ্ট। কিন্তু এই ছোট মাছ বড় মাছদের খুশি করতে গিয়ে কাজ সময়মত শেষ করা যায়না, তখন মেয়াদ বাড়াতে হয়, প্রকল্পের খরচও বাড়াতে হয়। যদি এদের উৎকোচ না দেয়া হয় তাহলে বিল তোলা আর কাজ শেষ করা উভয়ই মুশকিল!

আমাদের দেশে শিক্ষকরাও কম যান না! এমপিওভুক্ত বা সরকারী স্কুলগুলোতে যেখানে সরকার এসএসসি পরীক্ষার বোর্ড ফি নেয় বিভাগ অনুসারে ১৫০০ থেকে ১৯০০ টাকা। সেখানে আমাদের মহান শিক্ষকরা এই বাবদ সে বাবদ খরচ বাড়তি দেখিয়ে ফি নেন ২৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা। কেউ যদি টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করে থাকে তাহলে তো গেলো!  এই টাকা আরো বাড়বে। এই চিত্র কলেজগুলোতেও। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিত্র আবার ভিন্ন সেখানে ছাত্রদের কাছ থেকে বেশি নেয়ার চল নেই তেমন। তবে গবেষণা না করেই এর থেকে বরাদ্দ তোলা, সংশ্লিষ্ট বিভাগে ক্লাস না নিয়ে প্রাইভেটে ক্লাস নেয়া, ডিওটি পালন না করেই ভাতা তোলা এসব দৈনিক চিত্র। অাবার অনেক শিক্ষককে আমরা দেখছি ছাত্রদের গবেষণা নিজের নামে চালিয়ে দেয়া, পিএইচডি জালিয়াতি করা, পক্ষপাত হয়ে বিভিন্ন ছাত্রছাত্রীকে হয়রানি করা এসব৷ বিভিন্ন দলের লেজুড়বৃত্তি তো আছেই! শিক্ষকরা হলেন জাতির বিবেক, আর এই বিবেকেই যদি গুনপোকা ধরে তাহলে দেশ সমাজ বাঁচবে কী করে!

এ কথা আমরা সবাই জানি যে শেখ হাসিনা এদেশে প্রথম কমিউনিটি ক্লিনিক চালু করেন যাতে করে প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ, গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলো বিনামূল্যে চিকিৎসা, প্রাইমারি এইড গুলো পায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় সরকারি যে ওষুধ গুলো এখানে আসে তার শতকরা পঞ্চাশ ভাগও সাধারণ জনগণ পায়না। স্বাস্থ্যকর্মীরা এগুলো গোপনে বিক্রি করে দেয়। অাপনার নিকটস্থ ক্লিনিকে খোঁজ নেন অাপনি নিজেই দেখতে পাবেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পিয়ন থেকে কর্তা পর্যন্ত মহাচুরিতে ব্যস্ত। অামরা পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পিয়নের বাড়ি রয়েছে মেলবোর্ন শহরে। অার কর্মকর্তারা কতটুকু কী করেছেন তা অাল্লাহ মালুম। ডাক্তারদের অবস্থা অাবার অন্যরকম। যেমন-সরকারি হাসপাতালে সময় কম দিয়ে প্রাইভেটে রোগী দেখা।বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির উপঢৌকন গ্রহণ করে অযাচিতভাবে সেই কোম্পানির ঔষধ লেখা, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট দিয়ে সেখান থেকেও কমিশন গ্রহণ করা ইত্যাদি।

সবমিলিয়ে যদি বলি  বিগত একদশকে স্বাস্থ্যখাতে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ নেহাত কম ছিলো না তবুও আমাদের দেখতে হচ্ছে ভঙ্গুর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার শিরায়-উপশিরায় যে দুর্নীতি চলছে তা অার বলার অপেক্ষা রাখেনা! এই নিয়ে লিখতে গেলে একটা বই লেখা যাবে সম্ভবত!

ব্যাংকারদের চরিত্র আরেকটু মজার! সবাই যে এরকম করে তা কিন্তু নয় আবার অনেকে করে। নামে-বেনামে রাঘব বোয়ালদের লোন তুলতে সহায়তা করা এর বিনিময়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে এই ব্যাংক কর্মকর্তাদের দ্বারা। অনেকে রাজনৈতিক চাপে করে থাকেন আবার অনেকে নিজেই এরকম কাস্টমার খুঁজে বেড়ান।দেশের বড় বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনায় ব্যাংক কর্মকর্তারা জড়িত। ব্যবসায়ীরা, নেতারা কখনোই এককভাবে দায়ী নয় সাথে এই ব্যাংক কর্মকর্তারাও সমানভাবে দায়ী! আরেকটা তথ্য দেই অাপনাদের শুনলে চমকে যাবেন৷ দেশের প্রান্তিক কৃষকরা বিভিন্ন সমস্যায়, মন্দার সময় কৃষি ব্যাংক থেকে লোন তুলে থাকেন। কৃষকরা যদি সরাসরি লোন তুলতে ব্যাংকে যান তাহলে তাদের প্রচুর হয়রানির শিকার হতে হয়। ক্ষেত্রবিশেষে পর্যাপ্ত লোন পান না! যদি দরকার হয় ৫০ হাজার দেয়া হয় ২০ হাজার বা একটু কম বেশি। যদি দালালদের মাধ্যমে যায় তাহলে দ্রুত গতিতে যতটুকু দরকার ততটুকুই পায়। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এরকম দালাল থাকে যাদের যোগসাজশ থাকে ব্যাংক কর্মচারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে। এক লাখে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয়া হয় এই গরীব কৃষকদের থেকে। গতকালকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কীটনাশক অার সারের জন্য ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি অার ৫ হাজার কোটি টাকা স্বল্প সুদে কৃষি ঋণের ঘোষণা দিয়েছেন। শুনে অনেক খুশি হয়েছি। কিন্তু এই অর্ধ-শিক্ষিত দালালদের কথা মনে হলে আঁতকে উঠি!!

আরেকটা ইন্টারেস্টিং কথা আপনাদের বলি কারণ অাপনারা অনেকেই হয়তো জানেন না। প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকদের কৃষি তথ্য দেয়া, কৃষি জমির সমস্যা নিয়ে পরামর্শ দেয়া, ট্রেনিং দেয়া, উঠান বৈঠক করা এসব করার জন্য একজন কৃষি কর্মকর্তা সরকারিভাবে প্রত্যেক এলাকায় নিয়োগ দেয়া আছে।এদেরকে আমরা বিএস নামে জানি। উনারা কী করেন! দায়িত্ব তো পালন করেন ই না উল্টো এলাকার প্রভাবশালীদের সাথে একটা হয়ে সরকারি অনুদান, কৃষি কার্ড নিজেদের পকেটে পুরে দেন। সরকারি ট্রেনিং আসলে ওই প্রভাবশালীদের দেয়া হয়, নমুনা বীজ, সার সরকারী থেকে আসলেও ঔসব কুচক্রী মহলকে অল্প কিছু লাভের জন্য দিয়ে দেয়া হয়। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে আমার দেশের কৃষক। কৃষকদের চেয়ে অসহায়, এই বাংলার জমিনে অামি কাউকে দেখিনি! আর এসব তদারকির জন্য নেই কোনো সরকারি উদ্যোগ!

এবার আসি চাল চোরদের প্রসঙ্গে। চাল চোররা অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছে। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নাই। তবে এই চাল চুরি তৈরি হওয়ার পেছনে দায়ী রাষ্ট্র, দায়ী দেশের জনগণ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুয়েকজন চেয়ারম্যান-মেম্বার বাদে কোনদিন চাল চুরি হয়নি?! চেয়ারম্যান-মেম্বাররা চাল চুরি করবে এটাই ছিলো অঘোষিত নিয়ম। কিন্তু একবারো ভেবে দেখেছি কী কেন তারা চাল চুরি করে? একজন চেয়ারম্যানের বছরে বৈধ অায় হচ্ছে সর্বসাকুল্যে ২ লাখ টাকা। তাকে বছরজুড়ে বিভিন্ন সভা সম্মেলনে যেতে হয়, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যেতে হয়, স্কুলের ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অতিথি হতে হয় এছাড়াও বিভিন্ন গণকর্মসূচিতে যেতে হয় যেখানে গেলেই তাকে কিছু না কিছু অর্থ প্রদান করে আসতে হয়। এক জন চেয়ারম্যানের বছরে নূন্যতম খরচ আছে ২০ লাখ টাকা। কিছু কিছু চেয়ারম্যানের ক্ষেত্রে তা অর্ধকোটি টাকা। তারা আয় করে ২ লাখ টাকা খরচ ২০ লাখ টাকা। তাহলে বাকি টাকা সে কোথায় পাবে?

এজন্য তাকে চাল চুরি করতে হয়, বয়স্ক ভাতার কার্ড, বিধবা ভাতার কার্ড, পঙ্গু ভাতার কার্ড, কাবিখা কর্মসূচি, বন্যার অনুদান থেকেও টাকা চুরি করতে হয়। আবার পরেরবার ইলেকশন করবে এজন্য প্রায় অর্ধ-কোটি টাকা হয় জোগাড় করে রাখতে হবে।মাথার উপর কত চাপ! কারণ এদেশের জনগণ নির্বাচনের সময় চা খাবে, বিড়ি খাবে, পান খাবে, গুল দিবে ওই চেয়ারম্যানের টাকায়। এজন্যই অামি বলছি রাষ্ট্র আর জনগণ উভয়ে চুরি তৈরি করতে ওস্তাদ।

আরেকটি বেদনাদায়ক কথা হচ্ছে কী জানেন! প্রান্তিকপর্যায়ে রিক্সাওয়ালা, সিএনজিওয়ালা, সবজি বিক্রেতা, মাছ বিক্রেতা, দোকানদার পর্যন্ত সুযোগ বুঝে দাম বাড়ায়, ভাড়া বেশি নেয়, ওজনে কম দেয়, ভেজাল করে। বাংলাদেশ হচ্ছে এমন একটা দেশ যেখানে দুয়েকজন বাদে প্রায় সবাই চুরি করে। হয়তো চুরির পরিমাণটা কম অথবা বেশি।

আমি যদি এখন ইহাকে চুরের দেশ বলি, খুব কী ভুল বলব!

খালেদ সাইফুল্লাহ ইলিয়াছ
কবি ও সাবেক শিক্ষার্থী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট। 

Comments

comments