সরকারি চাকুরি থেকে সদ্য অবসরে আসা নজরুল সাহেব। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে পত্রিকা পড়ে, টিভিতে খবর, টক শো দেখে আর সাড়ে চার বয়সের একমাত্র নাতি আরশ এর সাথে খেলে। যদিও ষাটোর্ধ এ বয়সে দুরন্ত নাতির সাথে পেরে উঠা মুশকিল। খুব বেশি জ্বালায় যখন পত্রিকা নিয়ে বসেন। হেন কোনো দুষ্টুমি নেই যা করে না। ঘাড়ে চড়া থেকে বৃদ্ধ দাদার পেটে সজোড়ে ঘুষি। দাদা হিসেবে এতে যেনো বিরক্তির চেয়ে সুখটাই বেশি পান। এই যেমন এখন, ছেলে আর ছেলের বউ যাবে তাদের কলিগের বিয়ের পার্টিতে। নাতিকে জামা কাপড় পড়াতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে বউমার। নাতি দাদার ঘাড়ে উঠে বসে আছে, সাথে খেলনা গাড়ি। একটু আগে দাদাকে দেয়া চায়ের কাপ ভেঙেছে। ব্যালকনির ফ্লোরে এখনো চায়ের কিছুটা দাগ লেগে আছে। শত চেষ্টার পর অবশেষে তারা বের হতে পেরেছে। নাতির সাথে যুদ্ধে ক্লান্ত নজরুল সাহেব ভাবছে নিজের অতীতের কথা। নাতির বয়সি শিশুকালের উঠানে ঘাম ঝড়ানো বিকেল। সমবয়সীদের সাথে মাঠে বা বাড়ির পেছন দিকটার খোলা জায়গায় বিশাল আমগাছটার নিচের ছায়ায় ডাংগুলি, মার্বেল খেলা।।
মনে পড়ছে প্রথমবার স্কুল পালিয়ে পাশের মহিলা মাদ্রাসার এক ছাত্রীর পিছু নেয়া।। আহা কি দুর্দান্ত সে অনুভুতি।। ২ টাকা দিয়ে কেনা প্রেমের উপন্যাসের বই। নিজের অজান্তেই হেসে উঠলেন। স্কুলের শেষের দিকেই প্রথম পালিয়ে সিনেমা দেখেছিলেন। মনে পড়ে গেলো সে দুরন্ত বন্ধুদের। না জানি ওরা এখন কেমন। নজরুল সাহেব তো এখন চার বছরের নাতির সাথেই পারেন না। আর সেদিন সিনেমা হলে শীষ দেয়া নিয়ে সেকি গন্ডগোল। পাশের স্কুলের তিন ছেলেকে একাই পিটিয়েছিলেন।। পরে সে হলটাতে সিনেমা দেখতে টিকেট লাগতো না। সে কি বীরত্ব। বিয়ের পর অবশ্য টিকেট কেটেই রাজ্জাক সুচরিতার সিনেমা দেখেছেন। যদিও টাকা নিতে চায়নি টিকেট মাস্টার। কিন্তু নজরুল সাহেবের বেশ আত্মসম্মানে লাগছিল। হাজার হোক গায়ে তখন সরকারী চাকুরিজীবির সিল।
সময়ের সাথে সাথে বোধহয় এভাবেই সব কিছু পালটে যায়। এই যে, ছেলেটা বউ বাচ্চা নিয়ে বিয়ের পার্টিতে গেলো। রাতের বিয়ে। নিজেও গিয়েছেন এ ধরনের কিছু অনুষ্ঠানে। ভালো লাগে না। এসি, কড়া পারফিউমের গন্ধ, আর খাওয়া দাওয়া। ব্যাস এই….
এখন তো আরো দুরত্ব, করোনা নামে এক রোগ মানুষের মধ্যে মানসিক দুরত্বের সাথে সাথে শারীরিক দুরত্বও তৈরি করেছে বেশ। হাতে হাত মেলানো মানে হ্যান্ডশেক করা হয় না, কোলাকুলি গলাগলি নাই। আর তখন, বিয়ে মানে সাত দিন ধরে কত আয়োজন, রঙ ছিটানো, কাদা মাখামাখি, পিঠা পায়েস, পটকা ফুটানো সহ ইত্যকার আয়োজন। ছেলে বুড়ো যেনো সব এক।
মাগরিবের আযান শুনে ভাবনায় খান্ত দিয়ে অজু করতে গেলেন নজরুল সাহেব। নামাজ পড়ে বসলেন টিভির সামনে। চ্যানেল পাল্টাচ্ছেন আর পাল্টাচ্ছেন। কিন্তু পালটে না অনুষ্টানের ধরন। কোনো কিছুতেই বিনোদন খুজে পান না নজরুল সাহেব। সব কিছু যেনো গুমোট লাগে। ভেবে পান না কোথায় গেলো সেই রঙিন সময়ের সিনেমা নাটক? যে সিনেমা দেখে কেঁদে কেঁদে হল থেকে বেড়িয়েছেন, সমাজ পরিবর্তন হয়ে যেতো সিনেমার দেয়া এক বার্তায়। বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করে সিনেমা দেখতে যাওয়া ছেলেটি হাওমাও করে কেঁদে কেঁদে মাফ চায় বাবার কাছে। কে জানে সিনেমায় কি দেখে বাবার প্রতি দুর্ব্যবহারের অনুশোচনা জেগেছে।
নজরুল সাহেব জানেনা বা শুনেনি ঢাকার রাস্তায় এখন নাটকের চরিত্রের ফাঁসীর জন্য কোনো মিছিল হয় কি না। কে জানে এখনকার ছেলেরা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে মঞ্চ নাটক করে কিনা। কে জানে এখনকার ছেলেরা বৈশাখি মেলায় মুড়ি মুড়কি খায় কি না। কে জানে এখনকার বউয়েরা উঁকুন আনার ছলে একজনের মাথার আরেকজন বিলি কাটে কিনা। কে জানে সদ্য বিয়ে করা নতুন বউ পুকুর ঘাটে পাশের বাড়ির ভাবীর সাথে লাজুক গল্প করে কিনা। কে জানে নিজের ছেলেটিই কি বউকে লাল আলতা কিনে দিয়েছিলো? নজরুল সাহেব তো ঠিকই ছেলের মা কে কিনে দিয়েছিলো। সে নিয়ে চাচাতো ভাইয়ের বউদের কি হাঁসি।
ভাবনায় ছেদ পড়ে টিভির দিকে নজর গিয়ে। একটা গান দেখাচ্ছে, মিউজিক ভিডিও। কি যেনো বলছে মেয়েটা ‘পাটাকা পাটাকা’ বোধ হয়। মেয়েটার এই উদ্ভট গানের কথা আগে কোনোদিন শুনেনি নজরুল সাহেব, আর মেয়েটা এভাবে শারীরিক কসরত করছে কেনো? ভেবে পায় না নজরুল সাহেব, এটা কি গান নাকি অন্য কিছু? সাথে ছেলেমেয়ে গুলো নি নাচছে নাকি অন্য কিছু করছে? এই নাচের মুদ্রা কি? গানেরই বা স্বরলিপি গুলো কি? নাকি এখনকার গানে এসব কিছু লাগে না।
বড্ড অদ্ভুতুড়ে এখনকার প্রজন্ম। নজরুল সাহেবদের সময়কার খেলার মাঠঘাট গুলো ভরাট করে বাসাবাড়ি হয়েছে বিস্তর, নাতি আরশের খেলার জায়গা না থাকায় মাঠ হিসেবে বেছে নিয়েছে দাদার পিঠ আর জায়নামাজ। গত ৫০/৬০ বছরে মানুষও বেড়েছে দ্বীগুন, তিনগুন। সব ক্ষেত্রে নিশ্চই মেধাও বেড়েছে সে আনুপাতিক হারে। তাহলে এখনকার গান, নাটক, চলচ্চিত্র, মঞ্চ সব কিছুর এমন মেধাহীন হাহাকার কেনো? এখনকার কোনো বিনোদনেই দাগ কাটছে না কেনো? নাকি জেনারেশন গ্যাপ? কই এ প্রজন্মের হয়ে তার ছেলেও তো দেশিয় চ্যানেল দেখছে বলে চোখে পড়ে না, ছেলের বউও তো সিনেমা দেখতে নিয়ে যেতে বায়না ধরে না। যায় শপিংয়ে। এরা বিনোদনের ক্ষুদা মিটায় বিদেশী চ্যানেলে। ভীনদেশি সিনেমায়। বছরে দু একবার যে তার ছেলে, বউ বাচ্চাকে নিয়ে গ্রামে যেয়ে পুকুরে গোসল করে, মাছ ধরে, গাছ থেকে আম কাঠাল পেরে খায়, এসবে তো বোঝা যায় এখনকার প্রজন্মেরও শেকড়ের ক্ষুদা অনেক। মেটানোর দায়ও তো এদেরই। কেনো তবে ভীনদেশী সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠছে চিরায়ত বাংলার সন্তানেরা। নজরুল সাহেব জানলা দিয়ে নিয়ন আলোর দিকে তাকিয়ে নির্মল শৈশব, কৈশোর, আর সোনালী অতীত নিয়ে ভাবছেন আর নস্টালজিক হচ্ছেন। ভাবছেন তার নাতি বড় হয়ে কার গান শুনবে আব্দুল আলীমের নাকি এই যে পাটাকা না কি জানি গান এসবের? হঠাৎ নিজের বাবাকে নিয়ে একটা প্রশ্ন মাথায় এলো নজরুল সাহেবের। নিজেদের সংস্কৃতি নিয়ে বাবাও কি এরকম শংকিত ছিলেন?
Comments
comments