বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মনির নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তিনি বাল্যকাল থেকেই বঙ্গবন্ধুর খুবই স্নেহধন্য ছিলেন। কারণ, বঙ্গবন্ধুর বড় বোনের ছেলে ছিলেন মনি। সম্পর্কের দিক থেকে তাঁরা আপন মামা-ভাগ্নে। বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই তাঁর রাজনীতিতে পর্দাপণ। তাঁর একমাত্র রাজনৈতিক আর্দশ ছিলেন বঙ্গবন্ধু।
ষাটের দশকের শুরু থেকেই তিনি মেধা, পরিশ্রম, যোগ্যতা ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের জন্য বাংলার ছাত্র ও যুব সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেন। তারই প্রেক্ষিতে ১৯৬০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলেন এবং সেই আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য দীর্ঘদিন তিনি কারাভোগ করেন। তৎকালীন ১৯৬৬ সালে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার ছাত্রসমাজের জোরালো আন্দোলনে তিনি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত বাঙালির মুক্তি সনদ ছেষট্টির ছয় দফা আন্দোলনকে বাস্তবায়ন করতে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক। তিনি ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন কর্মসূচির অন্যতম উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর নেতৃত্বে গড়ে উঠেছিল মুজিব বাহিনী। তিনি মুজিব বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসাবে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন পর্যন্ত সব লড়াই সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর পাশে সর্বদাই ছায়ার মতো ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক মুজিব বাহিনীর সর্বাধিনায়ক শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে স্বাধীনতার পরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে এক যুব কনভেনশনের মাধ্যমে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে বাংলাদেশের প্রথম যুব সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করে এবং তিনি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা এই জাতীয় চার মূলনীতিকে মাথায় রেখে দারিদ্র্য দূরীকরণ ও বিমোচন, বেকারত্ব দূরীকরণ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, শিক্ষা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, আত্ননির্ভরশীল অর্থনীতি ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং যুবসমাজের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠাই সংগঠনটির মূল লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে দেশের সকল শ্রেণির মানুষের মধ্য থেকে প্রগতিশীল যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি সুশৃঙ্খল আদর্শিক সংগঠন গড়ে তোলার প্রত্যয়ই যুবলীগের উদ্দেশ্য। যুবলীগের নেতাকর্মীরা এই সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে এখন অবধি কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়া দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি ও সকল প্রকার অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বারবার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করার মাধ্যমে সব অন্যায়ের অনিয়মের তীব্র প্রতিবাদ করছে।
১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে বগুড়া ও চট্টগ্রামের যুবলীগ নেতারা নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে যুবলীগ নেতা নূর হোসেনের তাজা রক্তের বিনিময়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় স্বৈরশাসক এরশাদ। এছাড়া আরো অনেক যুবলীগের নেতাকর্মী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহিদ হন।
ছিয়ানব্বই সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন, একুশে আগস্ট ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা, সতেরই আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার প্রতিবাদে রাজপথে যুবলীগ ছিল সোচ্চার ও অপ্রতিরোধ্য। ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা আন্দোলন, ২০০৭ সালে শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন ও গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা পূর্ণবাস্তবায়নে রাজপথে থেকে যুবলীগ অগ্রনী ভূমিকা পালন করে। ১/১১ এর সময় শেখ হাসিনা কারান্তরীণ হলে তার মুক্তির জন্য রাজপথে আন্দোলনে সংগ্রাম করতে গিয়ে বহু নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের শিকার হয় শত-সহস্র যুবলীগ নেতা-কর্মী। ভোট বিপ্লবের মাধ্যমে ২০০৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে রাজপথে আওয়ামী যুবলীগের অবদান ছিল অতুলনীয়। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের বিচারকাজ সম্পন্ন ও হেফাজতের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনার বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিরোধে গড়ে তুলে আওয়ামী লীগ সরকারের ছায়াসঙ্গী হিসেবে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে আওয়ামী যুবলীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরবর্তীসময়ে বিএনপি জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, পেট্রোল বোমা ও জ্বালাও-পোড়াও করে সাধারণ মানুষদের হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে একটি অস্থিতিশীল ভীতিকর অবস্থা তৈরি করলে রাজপথে থেকে যুবলীগ তা প্রতিহত করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্ববর্তী সময়ে বিএনপি জামায়াতের নানা ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজপথে থেকে যুবলীগ মোকাবেলা করেছে। সর্বশেষ সপ্তম জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে শেখ ফজলে শামস পরশকে চেয়ারম্যান ও যুবলীগ নেতা মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে সাধারণ সম্পাদক করে যুবলীগের দায়িত্ব অর্পণ করেন। বৈশ্বিক মহামারি করোনা ভাইরাসের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যুবলীগের চেয়ারম্যান ও সম্পাদকের সার্বিক তত্ত্বাবধানে বিপর্যস্ত মানুষের নানা সংকটে পাশে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে রাজপথের লড়াই সংগ্রামের সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। সংগঠনটির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মানুষের সচেতনতায় কাজ করেছে। সাবান, স্যানিটাইজার ও মাস্ক বিতরণ থেকে শুরু করে দরিদ্র, ভাসমান ও পথচারী মানুষদের মাঝে রান্না করা খাবার বিতরণ করেছে। চব্বিশ ঘণ্টা নাগরিক সেবা প্রদানসহ যুবলীগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকর্মীরা যার যার সাধ্য অনুযায়ী অসহায় নিপীড়িত মানুষের জন্য সার্বক্ষণিক পাশে থেকেছে।
মুজিববর্ষের কর্মসূচি ‘গাছ লাগাই, জীবন বাঁচাই’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে দেশব্যাপী যুবলীগের লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি পালন করে। করোনার সময় যখন কৃষকের ধান কাটার জন্য শ্রমিক সংকট দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে যুবলীগের নেতাকর্মীরা স্বেচ্ছায় কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের পাকা ধান কেটে মাড়াই করে নিজ নিজ বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছে। শুধু তাই নয়, করোনায় আক্রান্তের ভয়ে যখন নিজ পরিবারের আত্মীয়-স্বজন করোনায় মৃত ব্যক্তির দাফন কাজে এগিয়ে আসেনি ঠিক তখন যুবলীগ করোনায় মৃত ব্যক্তির জানাজা থেকে শুরু করে দাফন কাজ সম্পন্ন করেছে। যার ফলশ্রুতিতে করোনাকালীন সাধারণ জনগণের অন্তরের নির্ভরশীলতার এক প্রতীক হয়ে উঠে যুবলীগ। এছাড়াও যুবলীগ দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে অসহায়, দরিদ্র, ঘরবাড়িহীন ছিন্নমূল নিম্নবিত্ত মানুষের মাঝে সর্বদা বিভিন্ন প্রকার খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করে সাধারণ মানুষের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছে।
এই ধারাবাহিকতায় বিগত পঞ্চাশ বছর ধরে নানান আন্দোলন-সংগ্রামে হাজার হাজার যুবলীগ নেতাকর্মীর আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ উপমহাদেশের একটি সর্ববৃহৎ যুব সংগঠনে পরিণত হয়েছে। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হাঁটি-হাটি পা-পা করে সংগঠনটির আজ ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী বা সুবর্ণজয়ন্তী। যুবলীগের পরবর্তী পথচলা সাফল্যমণ্ডিত হোক সেই প্রত্যাশা করি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক
রেজুয়ান আহমদ শুভ্র
সহযোগী অধ্যাপক, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ -২২২৪, বাংলাদেশ।
Comments
comments