অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে ৪ মাসে কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের দানবাক্স থেকে এবার ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা পাওয়া গেছে। শনিবার (০৬ মে) রাত ৯টার দিকে গণনা শেষে টাকার এ হিসাব পাওয়া যায়। বিপুল পরিমাণ টাকা ছাড়াও দান হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রা ও স্বর্ণালংকার পাওয়া গেছে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি পাগলা মসজিদের দানবাক্স খুলে পাওয়া গিয়েছিল ২০ বস্তা টাকা। দিনভর গুনে পাওয়া গিয়েছিল ৪ কোটি ১৮ লাখ ১৬ হাজার ৭৪৪ টাকা। এ ছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রা, সোনা ও রুপার অলংকারও মিলেছিল। সে সময় তিন মাসে এই পরিমাণ টাকা জমা পড়েছিল মসজিদের দানবাক্সগুলোতে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সাধারণত তিন মাস পর পর পাগলা মসজিদের দান সিন্দুক খোলা হয়। এবার ৪ মাস পর দান সিন্দুক খোলা হয়েছে। প্রশাসনের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে টাকা গণনার কাজ হয়। সিনিয়র সহকারী কমিশনার শেখ জাবের আহমেদ, সিরাজুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার নাবিলা ফেরদৌস, সাদিয়া আফরীন তারিন, মসজিদের পেশ ইমাম মুফতি খলিলুর রহমান ও রূপালী ব্যাংকের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) রফিকুল ইসলামসহ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য এবং মসজিদ কমপ্লেক্সে অবস্থিত মাদ্রাসা ও এতিমখানার শিক্ষকেরা গণনাকাজ তত্ত্বাবধান করেন। এ সময় মাদ্রাসার ১১২ জন ছাত্র, ব্যাংকের ৫০ জন স্টাফ, মসজিদ কমিটির ৩৪ জন গণনাকাজ করেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১০ জন সদস্য নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
মসজিদ কমিটি জানায়, প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মসজিদটির দানবাক্সগুলোতে টাকাপয়সা ছাড়াও স্বর্ণালংকার, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগিসহ বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র দান করেন। কথিত আছে, খাস নিয়তে এ মসজিদে দান করলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। সে জন্য দূরদূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে এসে দান করেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী জানান, পাগলা মসজিদের দানবাক্সগুলো খুলে এবার রেকর্ড ৫ কোটি ৫৯ লাখ ৭ হাজার ৬৮৯ টাকা পাওয়া গেছে। টাকাগুলো রূপালী ব্যাংকে জমা করা হয়েছে। টাকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলার, সৌদি রিয়াল, মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত, উল্লেখযোগ্য পরিমাণে স্বর্ণালংকার পাগলা মসজিদের দানবাক্সে জমা পড়েছে।
টাকা গণনার এলাহী কাণ্ড নিজ চোখে অবলোকন করতে শহরের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গসহ নানা শ্রেণিপেশার মানুষ মসজিদে ছুটে যান। পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শওকত উদ্দীন ভূঞা জানান, সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ এ মসজিদে দান করেন। তাদের বিশ্বাস, এখানে দান করলে রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্তির পাশাপাশি মনের বাসনা পূরণ হয়। এই বিশ্বাস থেকেই দূর-দূরান্তের মানুষও এখানে দান করতে ছুটে আসেন। মজার বিষয় হচ্ছে, দান সিন্দুক খুললে চিঠি-পত্রও পাওয়া যায়। সেসব চিঠিতে দানকারীরা নিজেদের মনের বাসনার কথা লিখে দেন।
মসজিদ কমিটি সূত্রে জানা গেছে, জেলা শহরের নরসুন্দা নদীর তীরে এ মসজিদের অবস্থান। প্রাপ্ত দানের টাকা থেকে পাগলা মসজিদ এবং এই মসজিদ কমপ্লেক্সের অন্তর্ভুক্ত মাদ্রাসা, এতিমখানা ও কবরস্থানের ব্যয় নির্বাহ করা হয়। এ ছাড়া জেলার বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, এতিমখানায় সহায়তা করা হয়। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তাসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজেও এই ফান্ড থেকে টাকা খরচ করা হয়।
জানা গেছে, সুউচ্চ মিনার ও তিন গম্বুজবিশিষ্ট তিনতলা বিশাল পাগলা মসজিদ কিশোরগঞ্জের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থাপনা। জেলা শহরের পশ্চিম প্রান্তে নরসুন্দা নদীর তীরে হারুয়া এলাকায় অবস্থিত পাগলা মসজিদটি প্রথমে ১০ শতক জায়গায় প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরে এর আয়তন আরও বাড়ানো হয়েছে। মসজিটি এখন প্রায় চার একর জায়গাজুড়ে রয়েছে।
কথিত আছে, প্রায় ৫০০ বছর আগে ঈশা খাঁর আমলে ‘দেওয়ান জিলকদর খান ওরফে জিল কদর পাগলা’ নামে এক ব্যক্তি নদীর তীরে বসে নামাজ পড়তেন। পরবর্তী সময়ে ওই স্থানে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। পরে জিল কদর পাগলার নামানুসারেই মসজিদটি ‘পাগলা মসজিদ’ নামে পরিচিতি পায়।
জেলা প্রশাসক ও পাগলা মসজিদ পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ জানান, ছয়তলা বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মসজিদ ও ইসলামিক কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য পরামর্শ নিয়োগের টেন্ডার প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। পরামর্শক নিয়োগ শেষ হলে চূড়ান্ত ডিজাইন করা হবে। মসজিদ কমপ্লেক্স নির্মাণে প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৫ কোটি টাকা।
Comments
comments