২০০৪ সালের ২১ আগস্ট দলীয় কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে আছেন অনেকে।
সেদিনের বিভীষিকাময় পরিস্থিতি, দুঃস্বপ্ন ভুলতে পারছেন না তারা। এখনও কানে বেজে ওঠে আর্তচিৎকার। চোখের সামনে ভেসে ওঠে গ্রেনেড হামলায় ছিন্নভিন্ন মরদেহ, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা হাত-পা আর রক্তস্রোত।
ভাগ্যগুণে বেঁচে যাওয়া প্রত্যক্ষদর্শী এবং নির্মমভাবে নিহতদের স্বজনদের মূল চাওয়া- গ্রেনেড হামলা মামলার রায় আগামী ২১ আগস্টের আগেই কার্যকর হোক। তাছাড়া ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার অপূর্ণতা রয়েছে অনেকের। কারও কারও অনুযোগ- ১৬ বছরে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা তার ব্যক্তিগত চেষ্টায় এবং প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আহতদের অনেক সুযোগ-সুবিধা দিলেও দলীয়ভাবে তাদের জন্য কিছুই করা হয়নি। সামর্থ্যবান দলীয় অন্য নেতারা তাদের কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বেঁচে ফেরা কেউ কেউ।
মৃত্যু যন্ত্রণায় মাহবুবা পারভীন : ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় বেঁচে যাওয়া সাভারের মাহবুবা পারভীন ভুগছেন মৃত্যু যন্ত্রণায়। যুগান্তরকে বলেন, হামলার পর আমি অচেতন হয়ে মাটিতে পড়েছিলাম। সবাই মনে করেছিল মারা গেছি।
শরীরের ওপর দিয়ে হুড়োহুড়ি করে গেছেন অনেকে। শরীরের জয়েন্টে জয়েন্টে এখনও ব্যথা। বামপাশ প্যারালাইজড, ডানপাশেও সমস্যা। শরীরে এক হাজার ৭৯৮টি স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছি। গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানের পাশে যে তিন মহিলা রক্তাক্ত পড়েছিলেন তাদেরই একজন সাভারের এই মাহবুবা।
মৃত ভেবে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়। প্রায় ৬ ঘণ্টা পর স্বেচ্ছাসেবক কেন্দ্রীয় নেতা আশিষ কুমার মজুমদার লাশ শনাক্তকালে মাহবুবাকে জীবিত দেখতে পান। ৭২ ঘণ্টা আইসিইউতে থাকার পর জ্ঞান ফেরে তার। কলকাতার পিয়ারলেস হাসপাতালে নেয়া হলে জানানো হয়, তার শরীরে রয়েছে ১৮শ’ স্প্লিন্টার।
অ্যাডভোকেট শাহানারা : অ্যাডভোকেট কাজী শাহানারা ইয়াসমিন শরীরে ১৩৪টি স্প্লিন্টার বয়ে বেড়াচ্ছেন। তখন তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী আইনজীবী সমিতির মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য সাবেক কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক শাহানারা প্রস্তাবিত কমিটির সহ- সভাপতি। বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, শারীরিক অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। শরীরের বিভিন্ন স্থান ফুলে গেছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহানারা আক্তার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দুই দফায় ১৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেয়া হয়েছে। কিন্তু দলীয় ফান্ড থেকে কোনো সহায়তা পাননি।
সেদিনের বিভীষিকার বর্ণনা দিতে গিয়ে শাহানারা ইয়াসমিন বলেন, ‘নেত্রীর বক্তব্য শেষে সাংবাদিক গোর্কি ভাই এসে নেত্রীকে বলল, ‘আপা আমি ছবি নিতে পারি নাই।’ সে দু-তিনটা ছবি নিতেই হঠাৎ বিকট শব্দে গ্রেনেড বিস্ফোরণ হয়। প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয় আইভি আপার পায়ের কাছে। দেখলাম আইভি আপা পানিতে যেমন ডুবে যায় সেভাবে বসে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে সাদা-কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলি পাকিয়ে উপরে উঠতে লাগল। এরপর অনুভব করলাম আমার ডান পা জ্বলে উঠছে। পা টানতে পারছি না। পরপর বিকট শব্দে কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পা ছেঁচড়ে কিছুদূর এগিয়ে যেতেই সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলি।
স্প্লিন্টারগুলোই সম্পদ বজলুর রহমানের : কিডনি, অণ্ডকোষ, রক্তনালিসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেডের ৫৮টি স্প্লিন্টারই এখন সম্পদ ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি বজলুর রহমানের। তিনি বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ঘটনার সময় আমি অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলাম। তিনি বলেন, আমার শরীরে স্প্লিন্টারগুলোকে সঙ্গে নিয়েই কবরে যেতে চাই। আগামী ২১ আগস্টের আগেই এ গ্রেনেড হামলার রায় কার্যকর দেখতে চান বলে জানান বজলুর রহমান।
দলীয় মনোনয়ন চান নিহত সেন্টুর স্ত্রী : ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগের তৎকালীন উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক আহমেদ সেন্টু। বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, ৩৩ বছর বয়সে আমার স্বামী মারা গেছেন। ওই সময় আমার একমাত্র কন্যা আফসানা আহমেদের বয়স তিন বছর।
স্বামীর সম্মান ও মেয়ের দিকে তাকিয়ে অনেক সেক্রিফাইস করেছি। কিন্তু দল আমাকে সেভাবে সম্মান দেখাচ্ছে না। আমি প্রতি নির্বাচনের সময় সংরক্ষিত মহিলা আসনে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে ফরম কিনি। কিন্তু আমাকে কখনও মনোনয়ন দেয়া হয় না। তিনি বলেন, আমার স্বামী রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই করতেন না।
একমাত্র মেয়ে আফসানা এখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। আমি একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরি করে সংসার চালাই। আমাকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু কল্যাণ ফান্ড থেকে। মেয়ের পড়ালেখার খরচ বাবদ প্রতিমাসে দুই হাজার করে টাকা দেয়া হয়। এর বাইরে কোনো সহায়তা আমি পাইনি। দলীয় নেতাকর্মীরা তার বাবা মেয়ের কোনো খোঁজ নিচ্ছে না বলেও অভিযোগ তার।