নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় রিকশা শ্রমিক সংগঠনের ব্যানারে শ্রমিক কল্যাণের নাম করে রসিদ দিয়ে চলছে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি। মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়ার শাখার শ্রমিক নেতারা সিন্ডকেট চক্রের মদদে প্রশাসনের নাকের ডগায় পৌর শহরে প্রতিদিন নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা থেকে চাঁদা আদায় করছেন।
ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালকদের দাবি জোরপূর্বক রশিদ দিয়ে প্রতিদিন ২০ টাকা করে নিয়ে যায় সংগঠনের নেতারা। লকডাউনে বন্ধ থাকলেও এর আগে ও পরে গত কয়েক মাসে রিকশাা শ্রমিকদের ৮ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ওই সংগঠন ও সিন্ডিকেট চক্র।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত দেড় বছর ধরে কুলাউড়া পৌর শহরে নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার সংখ্যা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এ নিয়ে স্থানীয় ও জাতীয় গণমাধ্যমে গত বছরের ডিসেম্বরে সংবাদ প্রকাশিত হলে নিবন্ধনহীন এসব ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা পৌর শহরের চলাচলরোধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে যায়। কিন্তু কিছুদিন পর স্থানীয় একটি প্রভাবশালীমহলের মদদে আবার প্রকাশ্যে এসব নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু করে। সেই সুযোগে মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়া শাখার নেতারা স্থানীয় এক প্রভাবশালী নেতার মদদে আবারো শহরে নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিক্সা চালাতে শুরু করে। পরবর্তীতে ওই নেতাকে ৪০ পার্সেন্ট কমিশনের বিনিময়ে তাঁরই প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায় ওই সংগঠনের নেতারা শহরে জানুয়ারি থেকে ১০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু করেন। পরবর্তী করোনা সংক্রমণ রোধে লকডাউনের চাঁদা তোলা বন্ধ থাকে। গত জুন মাস থেকে চাঁদাবাজীতে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে সংগঠনের নেতা ও সিন্ডকেট চক্র। চাঁদার হার ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। রসিদ দিয়ে ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে এবার প্রকাশ্যে ২০ টাকা করে চাঁদা আদায় শুরু করা হয়। সংগঠনের ৩-৪ জন সদস্য প্রতিদিন শহরের রেল আউটার, উত্তরবাজার, স্টেশন চৌমুহনী এবং দক্ষিণবাজারসহ বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন দুপুর থেকে রিকশা আটকিয়ে চালকদের প্রকাশ্যে জোরপূর্বক রসিদ দিয়ে চাঁদা আদায় করছেন। গত প্রায় তিন মাস ধরে প্রতিদিন গড়ে তিন শতাধিক অটোরিকশা চালকদের কাছ থেকে প্রায় ৮ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, পৌর শহরের চৌমুহনী এলাকায় রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়া শাখার সদস্য জাহান মিয়া ব্যাটারি চালিত অটোরিকশা চালক মাখন মিয়া ও শাহ আলমের কাছে রসিদ দিয়ে ২০ টাকা করে চাইছেন। এ সময় মাখন মিয়া ও শাহ আলম টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে জাহান মিয়া জোরপূর্বক টাকা নেওয়ার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তাঁদের মধ্যে বাকবিতন্ডার সৃষ্টি হয়।
জাহান মিয়াকে রসিদ দিয়ে টাকা তোলার কারণ জানতে চাইলে বলেন, এটা সংগঠনের নির্দেশ। শ্রমিকদের কল্যাণে রসিদ দিয়ে টাকা তোলা হচ্ছে। গত কয়েক মাস ধরে প্রতিদিন আমি ৮০ থেকে ১২০ জন রিকশা চালকের কাছ থেকে রসিদ দিয়ে ২০ টাকা করে তুলি। এজন্য পারিশ্রমিক দেওয়া হয় আমাকে। সংগঠনের আরো ৩ জন সদস্য এভাবে শহরে রিকশা চালকদের কাছ থেকে টাকা তুলেন প্রতিদিন।
মাখন মিয়া ও শাহ আলম বলেন, প্রতিদিন আমাদের রিকশা আটকিয়ে রসিদ দিয়ে টাকা নেওয়া হয় দুর্ঘটনায় আহত ও অসহায় শ্রমিকদের সহযোগিতার কথা বলে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোন অসুস্থ রিকশা চালক সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা আমরা জানিনা।
অটোরিকশা চালক কাশেম মিয়া, শাকিল আহমদ, রুবেল ও আহম্মদ মিয়াসহ একাধিক রিকশা চালকের সাথে আলাপকালে তাঁরা বলেন, ট্রাফিক পুলিশ রিকশা আটক করলে সেটা ছাড়িয়ে আনার জন্য এবং কোন রিকশা চালক দুর্ঘটনায় আহত হলে তাঁর আর্থিক সহায়তার কথা বলে সংগঠনের পক্ষ থেকে করোনার লকডাউনের আগে ১০ টাকা করে নেওয়া হতো। বর্তমানে প্রতিদিন ২০ টাকা করে নেওয়া হয়। প্রতিদিনই সংগঠনের তিন-চারজন নেতা শহরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে আমাদের কাছে রসিদ দিয়ে এই টাকা নিয়ে যান। না দিলে রিকশা চালকদের হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক টাকা আদায় করেন। তাঁরা আরো বলেন, সংগঠনের সভাপতি আকাশ মিয়া ও সম্পাদক ছদরুল আমিনসহ সংগঠনের নেতারা আমাদের বলে দিয়েছেন প্রতিদিন নির্দিষ্ট সংগঠনের ফান্ডে টাকা না দিলে ট্রাফিক রিকশা আটক ও শহরে চলাচলে নিষেধ করলে তখন সংগঠনের পক্ষ থেকে কোন দায়িত্ব নেওয়া হবেনা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংগঠন সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি ও নেতা জানান, গত ডিসেম্বরে কুলাউড়া শহরে নিবন্ধনহীন ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার অবাধ চলাচল নিয়ে সংবাদ প্রকাশের পর ট্রাফিক পুলিশ বেশ কিছু রিকশা আটক করে। এর পরে মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়ার শাখার একটি কমিটি এনে দেন স্থানীয় এক শ্রমিক লীগ নেতা। এবং শহরে রিকশা চলাচলে প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ট্রাফিক পুলিশ যাতে বাধা প্রদান না করে সেজন্য আরেক প্রভাবশালী নেতা মদদ প্রদান করেন। এজন্য প্রতিদিন রিকশা চালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে সেই আদায়কৃত চাঁদার ৪০% কমিশন দেওয়া হয় ওই প্রভাবশালী নেতাকে। তারা আরো জানান, গত জানুয়ারি মাসের প্রথম দিক থেকে ১০ টাকা করে রিকশা চালকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা হতো। গত মার্চ মাসের শেষ দিকে করোনার লকডাউন শুরু হলে চাঁদা তোলা বন্ধ থাকে। গত জুন মাস থেকে সেই চাঁদার পরিমাণ ১০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা করে আদায় করা হয়।
বিষয়টি জানতে মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন কুলাউড়ার শাখার সভাপতি আকাশ মিয়া ও সম্পাদক ছদরুল আমিন মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা প্রতিদিন ২০ টাকা করে চাঁদা আদায়ের কথাটি স্বীকার করে বলেন, সাংগঠনিক ব্যায় নির্বাহ করতে এবং দুর্ঘটনায় আহত রিকশা চালকদের চিকিৎসা সহায়তার জন্য এই টাকা তোলা হয়। আমরা কমিটির সিদ্ধান্তমতে টাকা সংগ্রহ করছি। এখন পর্যন্ত কত টাকা চাঁদা উত্তোলন করা হয়েছে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তারা কোন সদুত্তর দিতে পারেননি।
এ ব্যাপারে মৌলভীবাজার জেলা রিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন জেলা শাখার সভাপতি সোহেল আহমদ মোবাইল ফোনে বলেন, কুলাউড়ায় ঝামেলা বেশি তাই সেখানে প্রতিদিন চাঁদা সংগ্রহের অনুমতি দিয়েছি। প্রতিদিন চাঁদা আদায়ের নির্দেশ দেওয়ার কোন বৈধ অনুমতি সংগঠনের আছে কিনা জানতে চাইলে সোহেল আহমদ কোন সদুত্তর দিতে পারেন নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. ইয়াদৌস হাসান বলেন,‘বিষয়টি আমি জানি না। যদি নজরে আসে তাহলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’