সেদিন আমবাগানে আমরা কয়েকজন ক্রিকেট খেলছিলাম। শর্টক্রিজ। তখন চৈত্রের মধ্যদুপুর। প্রচণ্ড রোদ উঠেছে। ওই রোদে দাঁড়ালেই চিড়বিড় করে ওঠে সারা শরীর। সুর্যের উত্তাপে শুকিয়ে উঠেছে গাছেদের কচি কচি পাতা আর মাঠের সবুজ দূর্বাঘাস। আমাদের স্কুল-মাঠেও খালি পায়ে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। গরমে পায়ের তলায় ছাঁৎ করে ওঠে অবস্থা।
আমরা তাই ব্যাট-বল নিয়ে ঢুকে পড়েছিলাম পাশের আমবাগানের ভেতর। বাগানে দশ-পনের হাত দূরে দূরে লাগানো হয়েছে আমগাছ। শর্টক্রিজে ক্রিকেট খেলার চমৎকার একটি জায়গা বলা যায়। এখানে মাথার ওপর আমপাতার ঘন ছাউনি ৷ এই ছাউনি ভেদ করে রোদ এসে সহজে মাটিতে পড়ে না। বাগানজুড়ে তাই লেপটে রয়েছে এক অদ্ভুত মোলায়েম শীতলতা।
ফাহাদ ব্যাটিং করছিল। রাজু বোলার। শর্টক্রিজে ফাস্ট বলের নিয়ম নেই। রাজু আচমকা ছুটে এসে ফাস্ট বলের চেয়েও প্রচণ্ড গতিতে ফাহাদের দিকে বল ছুড়ে দিল। বাতাসে সাঁ সাঁ শব্দ তুলে লাল স্কচটেপ দিয়ে পেঁচানো সেই বলটি গিয়ে ছিটকে পড়ল ফাহাদের মুখে।
সঙ্গে সঙ্গে ‘ও মাগো’ বলে কাতরে ওঠে ব্যাট ছেড়ে দিল ফাহাদ। দু’হাতে মুখ চেপে ধরে ধপাস করে বসে পড়লো মাটিতে। আমরা ভয়ানক আশঙ্কায় কেঁপে ওঠে তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলাম ফাহাদের দিকে। ‘কী হয়েছে? দেখি দেখি!’ বলে ওর চেপে ধরা হাতটা টেনে সরাতেই ধড়াস করে ওঠলো আমাদের বুক। বলের চোট লেগে ফাহাদের নিচের ঠোঁট কেটে গেছে। গলগল করে অনবরত রক্ত বেরোচ্ছে। নিচের পাটির দাঁত ভেঙে গেছে কি-না কে জানে!
আমরা তখন এই ঘটনার কোনো তল খুঁজে পাচ্ছিলাম না। রাজু এটা কী করলো? হঠাৎ আমরা মাথা তুলে দেখি, খুবই আশ্চর্য ব্যাপার, রাজু এখনো জ্বলন্ত চোখে ক্রিজের মাথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। ছুটে এসে আহত ফাহাদকে ধরছে না। এর মানে কী? রাজু কি তাহলে ইচ্ছে করেই এমনটি করেছে? ফাহাদের সাথে কোনোকিছু নিয়ে ওর লাগালাগি হয়েছিল কোনোদিন?
তারপর আমরা জানতে পারলাম আসল ঘটনা। দু’দিন আগে ৯ম শ্রেণির রিক্তা আপাকে প্রেমপত্র দিতে গিয়েছিল মামুন। সে আমাদের স্কুলের সকল ছাত্রের বড়ভাই। যাকে বলে ক্যাডার। মাথার চুলগুলো কোঁকড়ানো। পেটানো স্বাস্থ্য। সবসময় কালো ফ্রেমের একটা চশমা পরে থাকে।
আমরা ওকে খুব ভয় পাই। ওর সব হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করি। সামনাসামনি এমন ভাব দেখাই, যেন আমরা ওর খুব অনুগত। অথচ ভেতরে ভেতরে প্রচণ্ড ঘৃণা করি রাস্কেলটাকে।
মামুন খুব দুশ্চরিত্রের একটা ছেলে। রাস্তাঘাটে মেয়েদের একা পেলে তাদের বুকে হাত মারার কলঙ্ক আছে ওর নামে। আমাদের স্কুলের অনেক মেয়েই নাকি বহুবার এই ঘটনার শিকার হয়েছে। স্যারদের কাছে এসে বদমাশটার নামে তারা নাকি নালিশও করেছে। কিন্তু স্যারেরা প্রতিবারই মামুনের ভয়ে এড়িয়ে গেছেন পুরোপুরি। মুখ ফোটে কিছু বলার সাহস পেতেন না ।
এই নিয়ে ক’দিন আগে প্রতিবাদস্বরূপ ফেসবুকে একটা গ্রুপ খুলে ফেলেছিল ফাহাদ। গ্রুপটির নাম- ইভটিজিংমুক্ত সুন্দর সমাজ চাই। সেই গ্রুপে ফাহাদ আমাদের স্কুলের সব ফেসবুকচালক ছেলেমেয়েদের ইনভাইট করেছিল। তারপর থেকে ইভটিজারদের বিরুদ্ধে গ্রুপে নিয়মিত স্ট্যাটাস দিতে থাকে সে। এভাবে ধীরে ধীরে একপ্রকার সচেতনতা গড়ে ওঠছিল আমাদের ফ্রেন্ড-সার্কেলের ভেতর।
স্কুলে মামুনের কিছু দুশ্চরিত্র চ্যালা আছে। ওরা গ্রুপের সব স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট নিয়ে রাখতো। পরেরদিন মামুন স্কুলে এলে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব তাকে দেখাতো। অথবা কখনো স্ক্রিনশটগুলো সেন্ড করে দিত মামুনের ইনবক্সে। এই সূত্র থেকেই বোধহয় একধরনের প্রতিহিংসামূলক হিংস্রতা দানা বাঁধছিল মামুনদের ভেতর।
একদিন দুপুরে মামুন হঠাৎ রিক্তা আপাকে প্রপোজ করে বসলো। ওর প্রপোজের ভঙ্গিটা ছিল বেশ নাটকীয়। স্কুল তখন ছুটি হয়ে গেছে। রিক্তা আপা বুকে বই চেপে ধরে বেণি দুলিয়ে দুলিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসছেন। তিনি যখন স্কুলের সামনের পুকুরপাড় পর্যন্ত চলে এলেন, পেছন থেকে দৌড়ে এসে তার পথ আটকে দাঁড়াল মামুন। রিক্তা আপা ভয়ে হঠাৎ শিউরে উঠেছিলেন তখন।
মামুন রিক্তা আপার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে দুটো টকটকে লাল গোলাপের ফাঁকে একটা ছোট্ট চিরকুট বাড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমাকে ভালোবাসি, রিক্তা। সেইসময় স্কুলের ছাত্রছাত্রী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মামুনের এই মেকি নাটক দেখছিল। আর হেসে কুটিকুটি হয়ে লুটিয়ে পড়ছিল একজন আরেকজনের ওপর।
বিব্রত রিক্তা আপা তখন কী করবে বুঝে ওঠতে পারছিলেন না। আচমকা লজ্জায় লাল হয়ে ওঠা চেহারায় গোলাপদুটো ছোঁ মেরে নিয়ে গিয়ে পায়ের তলায় পিষে ফেলেছিলেন তিনি। তারপর আমাদের সবাইকে পুরোপুরি অবাক করে দিয়ে, রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে ফুটবলের গায়ে লাথি মারবার মতো বাম পায়ের প্রচণ্ড এক লাথিতে পাশের পুকুরে ফেলে দিয়েছিলেন মামুনের থেঁতলে যাওয়া সেই প্রেমের গোলাপ।
বিস্ময়ে আমাদের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছিল। রিক্তা আপা দেখছি অসাধারণ সাহসিনী। হঠাৎ আমরা অবাক হয়ে দেখি, রিক্তা আপা ফুঁপিয়ে উঠেছেন। সহপাঠীদের চোখের সামনে এইরকম লজ্জাজনক অবস্থায় পড়ে তার চোখে পানি এসে গেছে। তারপর প্রগাঢ় এক বেদনায় চোখ মুছতে মুছতে হনহন করে সেখান থেকে চলে এসেছিলেন রিক্তা আপা।
এই ঘটনার পর, সেদিন সন্ধ্যাবেলা ফাহাদের ফেসবুক গ্রুপে আমাদের ক্লাসের এক ছাত্র স্ট্যাটাস দিয়েছিল। স্ট্যাটাসটি ছিল এরকম- ‘প্রেমপত্র দিতে গিয়ে অত্যন্ত বাজেভাবে হেনস্তা হতে হলো জনৈক ইভটিজারকে।’ স্ট্যাটাসের শেষ দিকে ছিল দুর্দান্ত হা হা রিয়েক্টের তিনটে স্টিকার। হাসিতে চোখ ফেটে পানি বেরিয়ে পড়েছে অবস্থা।
রাজু মামুনের লোক। সে কি তাহলে ফেসবুকের এই ঘটনাটিকে কেন্দ্র করেই মামুনের হয়ে ফাহাদের ওপর ঝাল মেটাচ্ছে আজ? তুই শালা কেন ওই গ্রুপ খুলতে গেলি?
আমরা ফাহাদকে ধরাধরি করে একটা গাছের গুঁড়িতে নিয়ে বসালাম। একজন ছুটে গিয়ে স্কুলের টিউবওয়েল থেকে সেভেন আপের বোতলে করে পানি এনে ওর মুখের শুকিয়ে যাওয়া রক্ত ধুয়ে দিতে লাগল। ওকে দ্রুত ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলাম। ঠিক তখনই, পেছন থেকে প্রচণ্ড এক ধাক্কা দিয়ে আমাদের দূরে ঠেলে দিলো মামুন । আশ্চর্য, ও হঠাৎ কোত্থেকে এসে গেছে?
তারপর মামুনের এক পদলেহী চ্যালা ফাহাদের ঘাড়ে প্রচণ্ড এক থাপ্পড় মারে। টি-শার্টের কলার চেপে ধরে টেনে তোলে ওকে। আর মামুন তখন হিংস্রমুখে নেতিয়ে পড়া ফাহাদের নাকে-মুখে গদাম করে তিন-চারটে ঘুষি বসিয়ে দেয়।
সেই ঘুষির চোটে ছিঁড়ে যায় আহত ফাহাদের নাক-মুখের চামড়া। ফিনকি দিয়ে পড়তে থাকে রক্ত। মুহুর্মুহু ঘুষির আঘাতে আঘাতে ফাহাদ এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, সে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে প্রতিরোধ ক্ষমতা। আমরা কয়েকজন ‘কী হয়েছে? থামেন! থামেন!’ বলে পেছন থেকে পাষণ্ডদের থামাতে যাচ্ছিলাম। আর তখনই দেখতে পেলাম, ওপাশে রাজু প্যান্টের পকেট থেকে চকচকে একটা ক্ষুর বের করে ফেলেছে।
সঙ্গে-সঙ্গে প্রচণ্ড ভয়ে আমরা সেঁধিয়ে গেলাম নিজেদের ভেতর। আচমকা মোটর সাইকেলের ব্রেক কষে ধরার মতো প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমাদের সন্ত্রস্ত আত্মা একচুলও আর সামনে এগোতে দিলো না আমাদের। আমরা তখন, কী ভেবে যেন হঠাৎ পেছন ঘুরে ছুটতে শুরু করলাম। ছুটতে ছুটতে প্রকাণ্ড এক আমগাছের আড়ালে এসে লুকিয়ে পড়লাম টুপ করে।
রাজু সেই ধারালো ক্ষুরটি দিয়ে কচকচ করে গরুর চামড়া কাটার মতো টেনে টেনে ফাহাদের পিঠ কাটছিল। আর আমরা কতিপয় মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ মিলে আমগাছের সেই আড়াল থেকে মাথা বের করে ভয়ার্ত চোখে দেখছিলাম নারকীয় সেই হত্যাকাণ্ড।
লেখক:- আলমগীর মুরতাজা
Comments
comments