ঢাকাবুধবার , ৮ জুলাই ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. আন্তর্জাতিক
  3. খেলাধুলা
  4. দেশজুড়ে
  5. পজিটিভ বাংলাদেশ
  6. ফটো গ্যালারি
  7. ফিচার
  8. বিনোদন
  9. ভিডিও গ্যালারি
  10. সারাদেশ
  11. সাহিত্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

নৌ দূর্ঘটনা ও তার প্রতিকার

প্রতিবেদক
Kolom 24
জুলাই ৮, ২০২০ ৬:১৬ অপরাহ্ণ
Link Copied!

১৯১২ সালে টাইটানিক জাহাজ ডুবার ধ্বংসযজ্ঞের মর্মন্তুদ কাহিনী আমরা শুনেছি। শুনেছি অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত জোনেথান সুইফট এর গালিভারস ট্রাভেলস কিংবা ডেনিয়েল ডিফোর রবিনসন ক্রুসোর কাহিনী। উভয় ঘটনায় জাহাজ দূর্ঘটনার হৃদয়বিদারক দৃশ্য আমরা পাই। সেই দৃশ্য যেন বাস্তবতায় রুপ নিচ্ছে নদীমাতৃক আমাদের এই বাংলাদেশে। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়। তা হলো সাহিত্যের ভ্রমণকাহিনীতে জাহাজ দূর্ঘটনার কারণ বৈরি আবহাওয়া হলেও আমাদের দেশে এর অধিকাংশ কারণ আমাদের নিজেদের অবহেলা ও অদক্ষতা।

ছোট বড় ৭০০ এর বেশি নদী আমাদের দেশে জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে। দেশে এখনও ত্রিশ শতাংশের বেশি লোক প্রায় ২৪১৪০ কিলোমিটার নদীপথ ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি নগর, বড় শহর বা বাণিজ্যিক এলাকাগুলো কোন না কোন নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে নৌপথই হলো গণপরিবহন বা পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। এখনো অনেক এলাকা রয়েছে যেখানে সড়ক বা রেলপথের সুবিধা না থাকায় সেখানে নৌপথই যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন।

কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, প্রতিবছর নৌ দূর্ঘটনা আমাদের শত শত মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। সড়ক দূর্ঘটনার চিত্র তুলনামূলক বেশি দৃশ্যায়মান হলেও নৌ দূর্ঘটনার ফলাফল তীব্রতর ও অধিক ভয়াবহ। যেমন ৫০ জন যাত্রী নিয়ে একটি বাস দূর্ঘটনা কবলিত হলে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১২ জনের মৃত্যু সংবাদ আমরা দেখেছি, কিন্তু একই সংখ্যক যাত্রী নিয়ে কোন লঞ্চ দূর্ঘটনার শিকার হলে যাত্রী সংখ্যার অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর খবরই আমরা পাই। গত ২৯জুন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এসে ‘মর্নিং বার্ড’ জাহাজটির দূর্ঘটনায় মৃত্যুর হার তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।

নৌ দূর্ঘটনায় শোকের মাতম আরো বেশি এই কারণে যে, সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত দেহ উদ্ধার বা শনাক্ত করা গেলেও নৌ দূর্ঘটনায় অনেক মৃতদেহ পানির নিচ থেকে উদ্ধার করা সম্ভবপর হয় না।

পত্রিকার পাতা বলছে যে বিগত ১৯৯১ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ছোট বড় ৫৭০ টি জলযান পানির নিচে তলিয়ে দূর্ঘটনায় পতিত হয়। এগুলোতে প্রাণ যায় ৩৬৫৪ জনেরও বেশি লোকের। এদের মধ্যে ৪৮৯ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এ হিসেব থেকে বুঝা যায় যে আহত ব্যতিরেকে বছরে অন্তত গড়ে ১৩০ জনকে প্রাণ দিতে হচ্ছে আমাদের নৌপথে। মৃতের সংখ্যা নিশ্চিতভাবে যথেষ্ট উদ্বেগজনক।

২০০৯ সালে কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলার দায়রা নদীতে ফেরি দূর্ঘটনায় ৪৭ জনের প্রাণহানি, একই সালে ভোলাগামী ‘এমভি কোকো-৪’ এর দূর্ঘটনা, ২০১২ সালে মুন্সিগঞ্জমুখী ২০০ যাত্রী নিয়ে নৌকাডুবি, একই সালে মেঘনা নদীতে ‘এমভি শরীয়তপুর-১’ এর দূর্ঘটনা, ২০১৪ সালের ‘এমএল পিনাক-৬’ ও ‘এমভি মিরাজ-৪’ এর দূর্ঘটনায় ১০৩ জনের মত্যু, ২০১৫ সালে পদ্মা নদীতে ফেরি দূর্ঘটনায় ৬৮ জনের মৃত্যু,২০১৬ সালে কীর্তনখোলা নদীতে লঞ্চ দূর্ঘটনায় মৃত্যু, ২০১৯ সালে বঙ্গোপসাগরে ট্রলার ডুবিতে মৃত্যু ও গত ২৯ জুন বুড়িগঙ্গায় ‘মর্নিং বার্ড’ ডুবে মৃত্যুর দৃশ্য সাম্প্রতিক বছরগুলোর নৌ দূর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

ডিপার্টমেন্টে অব শিপিং (ডিওএস) বাংলাদেশের অধিকাংশ নৌ দূর্ঘটনার পেছনে এক যানের সাথে অন্য যানের সংঘর্ষকে দায়ী করেছে। উপরোল্লিখিত দূর্ঘটনাগুলোর কারণ ভিন্ন হলেও অনেক সাধারণ কারণও লক্ষ্যণীয়। এগুলো হলো ১. ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত মালামাল বা যাত্রী বহন ২. চালকদের অবহেলা ও অদক্ষতা ৩. যন্ত্রাংশে ত্রুটি ৪. বৈরি আবহাওয়া ৫. যানের ত্রুটিযুক্ত গঠন ৬. অনিরাপদ নৌ রুট ৭. যানের মেয়াদোত্তীর্ণ ফিটনেস ৮. সংঘর্ষ ৯. লাইসেন্সবিহীন অপারেটর ১০. রাডার বা রেডিও সরঞ্জামের অপর্যাপ্ততা ১১. অত্যধিক স্রোত ১২.নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণজনিত ঘাটতি ও ১৩. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োগহীনতা ইত্যাদি।

আমাদের দেশে অতীতের দূর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করলে চালকদের অদক্ষতা আর অবহেলায় দূর্ঘটনার মাত্রা বেশি বলে প্রতীয়মান হয়। বুড়িগঙ্গায় ‘মর্নিং বার্ড’ এর সাম্প্রতিক দূর্ঘটনার পেছনেও ‘ময়ূর-২’ এর চালকের অদক্ষতা ও অমনোযোগীতার বিষয়টি উঠে এসেছে। আবহাওয়া ও যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত কারণও অন্যতম যার ব্যাপারে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাও কম দায়ী নয়।

নৌ যাত্রা সুরক্ষার ব্যাপারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিনিস্ট্রি অব শিপিং (এমওএস), ডিপার্টমেন্টে অব শিপিং (ডিওএস) ও বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআইডব্লিউটিএ) নামে সরকারের তিনটি বিভাগ রয়েছে। মিনিস্ট্রি অব শিপিং এর উপর নৌপথ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নীতি প্রণয়নের দায়িত্ব ন্যস্ত। আর সরকারের ক্ষমতাবলে সব ধরনের নৌযানের নিরাপত্তা নিশ্চিত সহ যানের ফিটনেস পরীক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে ডিপার্টমেন্ট অব শিপিং (ডিওএস)। অপরদিকে বিআইডব্লিউটিএ নৌপথ ও যান নোঙর সংশ্লিষ্ট স্থানের নিরাপত্তা ও আবহাওয়া সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রেরণ নিশ্চিতকরণের জন্য নিয়োজিত। লোকবল ও প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্রপাতির সংকটের কারণে বিভাগগুলোতে আশানুরূপ কাজের অগ্রগতিতে বিঘ্ন ঘটছে বলেও জানা গেছে। বিআইডব্লিউটিএ এর সূত্রমতে দেশে নিবন্ধিত নৌযানের সংখ্যা মাত্র ৯৭২৫ টি। এর বাইরে অনিবন্ধিত বহু নৌযান নৌপথে নিয়মিত যাতায়াত করছে এবং এদের দ্বারাও অনেক দূর্ঘটনার শিকার হচ্ছে মানুষ।

নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ নৌপথ নিশ্চিতের জন্য ‘আভ্যন্তরীণ শিপিং অধ্যাদেশ -১৯৭৬’ রয়েছে যেখানে নৌযান বা পরিবহন সংক্রান্ত আইন ও অমান্যকারীদের শাস্তির বিধান সংক্রান্ত সকল বিষয় লিপিবদ্ধ আছে। আমার ধারণা এ বিষয়ে যান চালক, যান মালিক বা যাত্রী কেউ তেমন অবগত নয়। তাই যান মালিক, চালক ও যাত্রীদের স্বেচ্ছাচারী চলাচলের কারণে আমাদের বারবার দূর্ঘটনার দৃশ্য দেখতে হচ্ছে।

নৌ দূর্ঘটনা এড়ানোর জন্য প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি। একে অপরকে না দোষে সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে দূর্ঘটনা থেকে উত্তরণের। নৌপরিবহন সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে প্রশাসনিকভাবে আরো সক্রিয় হতে হবে। নৌচালক, মাস্টার, বন্দর তত্ত্বাবধায়ক ও যান মালিকদের তাদের কর্মকান্ডের ব্যাপারে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। প্রশিক্ষণ বা লাইসেন্সবিহীন চালক ও যানগুলোকে চিহ্নিত করে তাদের নৌ পরিবহন সংক্রান্ত কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে। আইন অমান্যকারীদের ভ্রাম্যমাণ আদালত বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের সহায়তায় আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। বিআইডব্লিউটিএ বা এ জাতীয় কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাস্টার, চালক ও যান চালনায় সম্পৃক্ত সকলকে বাৎসরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। বছরে একবার হলেও যানের ফিটনেস পরীক্ষা করতে হবে। বড় যাত্রীবাহী নৌকা সহ সকল লঞ্চ, জাহাজ বা স্টীমারে ওয়াটারপ্রুফ কক্ষ নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীবাহী বড় জাহাজ বা জলযানে জীবন রক্ষাকারী ছোট নৌকা সহ আনুসঙ্গিক উপকরণ আছে কিনা যাত্রার পূর্বেই তা পরীক্ষা করতে হবে।

যাত্রার অব্যবহিত আগে দূর্ঘটনার কবল থেকে উদ্ধার হওয়ার উপায় সংক্রান্ত নির্দেশনা যাত্রীদের উদ্দেশ্যে প্রদান করতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় লঞ্চে বা ফেরিতে দূর্ঘটনা থেকে বাঁচার সরঞ্জাম থাকা সত্ত্বেও যাত্রী সাধারণের অজ্ঞতার কারণে তা অব্যবহৃত থেকে যায়।। সাঁতার না জানা যাত্রীদের জীবন রক্ষাকারী জ্যাকেট সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।

অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে চড়া কঠোরভাবে দমন করতে হবে।এক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সাথে সাথে যাত্রীদের নিজেদেরকেও সচেতন হতে হবে।কারণ ঈদ বা পূজাপার্বণে ঘরমুখো মানুষের ঢল দেখে বুঝা যায় যে যাত্রীদেরও দোষ কোন অংশে কম নয়। নৌযান কর্তৃপক্ষের বাধা উপেক্ষা করেও অনেকে অতিরিক্ত যাত্রী হিসেবে ভ্রমণ করে দূর্ঘটনার পথকে ত্বরান্বিত করে থাকে। তাছাড়া দূর্ঘটনা প্রবণ এলাকায় অধিকতর দক্ষ ও প্রশিক্ষিত চালক সহ ভালো মানের যান নিশ্চিত করতে হবে। সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ এলাকার হাওরাঞ্চলে ইঞ্জিনচালিত ছোট বড় অনেক নৌকা যাত্রী ও মালামাল পারাপারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এদের বেশিভাগ যান বা চালকের নেই কোন সনদ, নেই কোন অভিজ্ঞতা। তাদের যত্রতত্র চালনায় ছোট বড় দূর্ঘটনা লেগেই রয়েছে। এগুলোর প্রতি নজরদারী জোরদার করতে হবে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো দূর্ঘটনা পরবর্তী উদ্ধারতৎপরতার দৃশ্য। বুড়িগঙ্গার তীরের কাছাকাছি এলাকায় ‘মর্নিং বার্ড’ ডুবে যাওয়ার পরবর্তীতে তাকে উদ্ধার করতে আসা উদ্ধারকারী জাহাজ ‘প্রত্যয়’ এর পথিমধ্যে ব্রীজের সাথে সংঘর্ষ আমাদেরকে আরো ভাবিয়ে তুলেছে। উদ্ধারকারী জাহাজ নিজেই দূর্ঘটনার শিকার হলে উদ্ধারতৎপরতা প্রলম্বিত হবে। তাই দূর্ঘটনা প্রবণ এলাকাগুলোর কাছাকাছি জায়গায় উদ্ধারকারী জাহাজের অবস্থান সর্বদা নিশ্চিত করতে হবে। উদ্ধারকারী জাহাজের ঘাটতি থাকলে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভাগের মনোযোগী হতে হবে।

আমাদের দেশের মতো নিম্ন আয়ের দেশে ভাড়ার স্বল্পতার কারণে মানুষ যাত্রা হিসেবে নৌপথ বেছে নিবে এটাই স্বাভাবিক। আর আমাদের নৌপথ তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পেলে সড়কপথে যানবাহনের উপর চাপও উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পাবে। নৌপথের দূর্ঘটনাজনিত করণে আমরা আর স্বজন হারানোর হাহাকার বা আর্তনাদ শোনতে চাই না। যাত্রা যেন হয় নিরাপদের, যাত্রা যেন হয় শান্তির।

লেখকঃ- বদরুল হুদা সোহেল
সহকারী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ঈশা খাঁ ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

Comments

comments