শনিবার (২৮ মে) নিকলী উপজেলার পাঁচরুখী গ্রামের সেলিনা হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার দুই মাস বয়সী শিশুকে নিয়ে বের হচ্ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। সেলিনার এই হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে আগ্রহ জাগলো কথা বলার। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাকে দেখে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে কারণ কি? তিনি উত্তরে বললেন, কে বলে আল্লাহ নেই। আল্লাহ না থাকলে আমার ছেলেটাকে বাঁচালো কে? ডাক্তার স্যার ফেরেশতা। স্যার না থাকলে আমার ছেলেটা বাঁচতো না, আল্লাহ স্যারকে পাঠিয়েছেন।
সেলিনার এই কথাগুলো শুনে জানার আগ্রহ বাড়িয়ে দিল। কারণ প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগীদের আত্মীয়স্বজনের মুখে এমন স্বর্গীয় হাসি দেখা যায় না। নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেল, গত ১ এপ্রিল (শুক্রবার) সেলিনা তার শিশু পুত্রকে নিয়ে আসেন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। চিকিৎসকরা বুঝতে পারেন সেলিনার পুত্রটি স্বল্প ওজন সম্বলিত অপরিণত শিশু। চিকিৎসকরা তাদের সর্ব্বোচটুকু দিয়ে শিশুটিকে বাঁচিয়ে তুলেন। পরবর্তীতে ৬ এপ্রিল শিশুটিকে উন্নত চিকিৎসার জন্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এখন শিশুটি সম্পূর্ণ সুস্থ ও তার ওজন ২৪০০ গ্রাম।
সরজমিনে নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাসেবা নেয়া কয়েকজন রোগী ও তাদের স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পরম মমতায় আমাদের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন তারা। কোনো ক্লান্তি নেই। রোগীর মাথায় যখন পরম মমতায় হাত রাখেন তখনই অর্ধেক অসুখ ভালো হয়ে যায়। এমন বহু চিকিৎসক আছেন যাঁদের রোগীরা ঈশ্বরের রুপ বলেই মনে করেন। আসল কারণটা হল মানসিকতার পার্থক্য। সত্যিই কেউ কেউ আসেন মানুষের সেবা করতে। সরকারি হাসপাতালে আসা রোগীরা কিন্তু বিরাট কিছু চান না। ভাল ব্যবহার, রোগীর সঙ্গে একটু সময় নিয়ে কথা বলে চিকিৎসা করলেই রোগী ও তাঁর পরিবার খুশি।
জানা যায়, এ যেন জাদুর কাঠির ছোঁয়ায় জেগে ওঠা। একসময় যে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ছিলো গোয়াল ঘরের মতো। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে সেটি সবার ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে। গোয়াল ঘর থেকে এখন আত্মবিশ্বাসে ঝলমল চিকিৎসাকেন্দ্র এটি। পিছিয়ে থাকা একটি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের এভাবে সামনে এগিয়ে ভরসার কেন্দ্র হয়ে উঠতে যিনি জাদুর কাঠি ছুঁয়েছেন, তিনি বর্তমান নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সজীব ঘোষ। চলতি বছরের ২২শে ফেব্রুয়ারি তিনি যোগদান করেন। যোগদানের পরেই অন্ধকারাচ্ছন্ন হাসপাতালকে ফোকাস লাইট ও অন্যান্য বৈদ্যুতিক বাতির মাধ্যমে আলোকিত করা, জরাজীর্ণ জরুরী বিভাগ আধুনিকিকরণ, প্যাথলজি বিভাগের মাধ্যমে রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষার ব্যবস্থা করন, অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে আলট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি, রোগীদের দুর্ভোগ লাঘবে নতুন সম্প্রসারিত ভবনে বহি:বিভাগ ও ফার্মেসি চালুকরণ, নবনির্মিত সম্প্রসারিত ভবনে অত্যাধুনিক বিছানা ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইনসহ পুরুষ অন্ত:বিভাগ চালুকরণ, পুরাতন ও জরাজীর্ণ সম্মেলন কক্ষকে প্রজেক্টর ও সাউন্ড সিস্টেমসহ আধুনিককরন, জরুরী বিভাগ ও অফিসে আইপিএস এর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক বিদ্যুতের সুব্যবস্থা, উদ্ভাবনী চিন্তা থেকে হাসপাতালের সিঁড়ির নিচে সুবিশাল স্টোর রুম তৈরি, হতদরিদ্র রোগীদের বিনামূল্যে ঔষধ সরবরাহের জন্য হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতি গঠন, অপরিণত ও কম ওজনের নবজাতকদের চিকিৎসার জন্য KMC (Kangaroo Mother Care) কর্নার গঠন, স্তন্যদানকারী মায়ের শিশুকে বুকে দুধ খাওয়ানোর জন্য ব্রেস্ট ফিডিং কর্নার, ডেলিভারি রুমকে আধুনিকায়ন করেন। “NCD corner যেখান থেকে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপে ভোগা নিকলীর তিন হাজার রোগী ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের ঔষধ বিনামূল্যে পাচ্ছেন।
স্থানীয়রা বলেন, মানুষের জীবন রক্ষা করা ইসলামি শরিয়তের পাঁচটি প্রধান উদ্দেশ্যের অন্যতম। আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে একজন মানুষের জীবন রক্ষাকে সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষার সঙ্গে তুলনা করেছেন। রাসুল (সা.) সাহাবায়ে কেরামকে কুসংস্কার পরিহার করে চিকিৎসা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছেন। অন্যদিকে চিকিৎসকদের ঈশ্বরের রুপ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। নিবেদিতপ্রাণ চিকিৎসক কম দেখা যায়। চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা দেওয়ার এই মানসিকতার কারণে এলাকার মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে এই হাসপাতাল।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের একাধিক স্বাস্থ্যকর্মী জানান, কিভাবে আরও সহজে প্রতিটি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং গ্রাম পর্যায়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়- এ ব্যাপারে প্রতিনিয়ত সভা-সমাবেশের মাধ্যমে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা এবং পরামর্শ প্রদান করেন স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সজীব ঘোষ।
নিকলী উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সজীব ঘোষ বলেন, নিকলী একটি অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনপদ। ১৯৯৪ সাল থেকে সুদীর্ঘ ৭ বছর আমার পিতা স্বদেশ রঞ্জন ঘোষ নিকলীতে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তার মুখে তখন অত্র দুর্গম এলাকার খেটে খাওয়া মানুষের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা শুনতাম। এছাড়াও এতদিন এলাকার মানুষকে সত্যিকার অর্থে সঠিক স্বাস্থ্য সেবা পেতে কিশোরগঞ্জ অথবা ভাগলপুর হাসপাতালে যেতে হতো, সেইসাথে অসহনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হতো। হাসপাতলে কোন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা ছিল না, ভবন ছিল জরাজীর্ণ। প্রান্তিক এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিতকল্পে আমি ও আমার সহকর্মীরা দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি।
ডা. সজীব ঘোষ বলেন, আমি বিশ্বাস করি, ‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।’ চিকিৎসক হিসেবে অসুস্থ-অসহায় মানুষের সেবা করার মাধ্যমেই সর্বশক্তিমানের সান্নিধ্য লাভের অবারিত সুযোগ স্বয়ং তিনিই আমাদেরকে দিয়েছেন। আশা করি সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু যে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন; মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা দ্রুতই তার বাস্তবায়ন করতে পারব।
Comments
comments