ঢাকারবিবার , ১২ এপ্রিল ২০২০
  1. অন্যান্য
  2. আন্তর্জাতিক
  3. খেলাধুলা
  4. দেশজুড়ে
  5. পজিটিভ বাংলাদেশ
  6. ফটো গ্যালারি
  7. ফিচার
  8. বিনোদন
  9. ভিডিও গ্যালারি
  10. সারাদেশ
  11. সাহিত্য
আজকের সর্বশেষ সবখবর

আমার কোয়ারেন্টাইন অভিজ্ঞতা এবং মানবাধিকার ও গণতন্ত্র

প্রতিবেদক
Kolom 24
এপ্রিল ১২, ২০২০ ৫:৫২ অপরাহ্ণ
Link Copied!

‘করোনা ভাইরাস’ বর্তমানে পৃথিবীতে এক আতংকের নাম। তার ভয়াবহতায় পৃথিবীতে বিরাজ করছে স্থবিরতা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে জনজীবন, কাঁদছে মানবতা। এককথায়, মুহুর্তের মধ্যেই যেন সে বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীকে। তার কাছে পরাস্ত জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সামরিক শক্তিতে বলিয়ান রাষ্ট্রগুলোও। তার রেহাই থেকে নিস্তার পেতে মানুষের চেষ্টার অন্ত নেই।

বলতে গেলে, বর্তমানে পুরো পৃথিবীর মানুষই গৃহে অবস্থান করছেন এবং জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হচ্ছেন না। নানা প্রয়োজনে গৃহের বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সে সুযোগ পুরোপুরি পাচ্ছেন না। এমনকি খাদ্যসহ মৌল মানবিক চাহিদা মেটানোর প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা আর আগের মতো ভোগ করছেন না। অর্থাৎ এককথায়, সবকিছু আর নিজের ইচ্ছেমাফিক চলছে না। তবে একজন নাগরিকের মৌল মানবিক চাহিদা পূরণ করা অবশ্যই রাষ্ট্রের দায়িত্ব এবং কর্তব্য। কিন্তু সেক্ষেত্রে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত রাষ্ট্রে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়।

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি উন্নয়নশীল দেশ। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কাছে উন্নত, অনুন্নত কিংবা উন্নয়নশীল বলে কিছু নেই। নেই সাদা-কালো বিভাজন। নেই কোন ধর্মের বিভাজন। আর সেজন্য সে পুরো পৃথিবীকে ক্রমান্বয়ে ভয়াবহতায় আচ্ছন্ন করে ফেলছে। তার কারণে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে পুরো পৃথিবী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা, সে তার বিস্তার ঘটাচ্ছে ভয়াবহভাবে। পরিত্রাণ পায়নি বাংলাদেশও।

আর, সেজন্য জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার কথা ভেবে গত ২৬ মার্চ সরকার পুরো দেশকে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করে। জনগণকে গৃহে অবস্থান করার পাশাপাশি বিভিন্ন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার নির্দেশনা প্রদান করে সরকার। এর ফলে অনেকেই কোয়ারেন্টাইন মেনে চলছেন। কিন্তু পার্থক্যের বিষয় হলো যারা বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইন এবং সাধারণ কোয়ারেন্টাইন এর মধ্যে।

করোনা ভাইরাসের কারণে সম্প্রতি আমি আমার একাডেমিক গবেষণার কাজ পুরোপুরি শেষ না করেই থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফিরে এসেছি। সে হিসেবে আমি একজন বিদেশ ফেরত ব্যক্তি। ইতোমধ্যে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ করেছি। শুধু আমি নই, সাথে আমার পরিবারও (স্বামী ও এক কন্যা সন্তান)। এখন, আমি আমার কোয়ারেন্টাইনে অংশগ্রহণমূলক অভিজ্ঞতার কিছু কথা বলবো।

কোয়ারেন্টাইন শুরু হবার পূর্বেই কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্রয় করে রেখেছিলাম। তা দিয়েই কোনমতে ১৪ দিন পার করেছি। আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সাথে শুধু ফোনে যোগাযোগ রেখেছি। প্রথম দুয়েকদিন কিছুটা অস্বস্তিবোধ করলে পরে তা খুব সহজেই মানিয়ে নিতে আর সমস্যা হয়নি। কিন্তু সমস্যাটা আমার ৮ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে। তাকে ঘরের মধ্যে আটকে রাখাটা আমার জন্য অনেক কষ্টসাধ্য হলেও আর কোন উপায় ছিল না। সে সারাক্ষাণ খিটখিটে মেজাজ দেখাই, চিৎকার-চেচামেচি শুরু করে। তার বিভিন্ন ধরণের বাহানা; প্রতিবেশীদের রুমে যেতে দিতে হবে, বাইরে খেলার সুযোগ দিতে হবে, বাইরে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে…. ইত্যাদি। এভাবে কোনরকম বুঝিয়ে তাকে বাসায় আটকে রাখতে হয়েছে। কি আর করবো! সারাদিন আমি তার খেলা ও টিভি দেখায় সঙ্গ দিয়েছি। অতিরিক্ত টিভি দেখার ফলে তার চোখে কিছুটা সমস্যা দেখা দেই।

কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এক নয়। মৌল মানবিক চাহিদার অনত্যম খাদ্যের যোগান কিভাবে আসবে- সেদিকে রাষ্ট্রের দায়িত্ব কী? কিংবা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের (যে প্রতিষ্ঠানে আমি বা আপনি কর্মরত) দায়িত্ব কী? এক্ষেত্রে রাষ্ট্র হচ্ছে প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য বাহক। আমরা এর জন্য হলাম অধিকারের ধারক (Rights holder)।

প্রথমদিকে, বিদেশ ফেরতগামীদের বিমানবন্দরে অবতরণের পর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় এবং যাদের মধ্যে করোনার কোন উপসর্গ পাওয়া যায়নি- তাদেরকেও হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। বিদেশ ফেরত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে একটি কৌশল অবলম্বন করা হয়, সেটি ওই ব্যক্তির হাতে কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনাবলীযুক্ত ‘সিলমোহর’। কিন্তু হাতে পানি লাগলে কয়েকদিনের মধ্যেই সেই ‘সিলেমোহর’ মুছে যায়। নিজ নিজ এলাকায় এসব বিদেশ ফেরত ব্যক্তিদের সম্পর্কে পুলিশকেও অবহিত করা হয়। কিন্তু পুলিশের দায়িত্ব কী? কেবলমাত্র আপনি বা আমি বাসায় অবস্থান করবো- তা নিশ্চিত করা? নাকি আপনার বা আমার অন্যান্য মৌল মানবিক প্রয়োজন আছে কি-না তাও নিশ্চিত করা?

আমি পেশায় বাংলাদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় নিযুক্ত আছি। আমি রাষ্ট্রের এবং প্রতিষ্ঠানের দেয়া নির্দেশনাবলী মেনে চলছি। কিন্তু রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠান আমাকে সেই নির্দেশনাবলী মেনে চলার জন্য যে ধরণের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করার কথা, তার কতটুকু করেছে বা করছে? আমার বা আপনার ঘরে খাবার আছে কিনা, শারিরীক অবস্থা কেমন, মানসিক অবস্থা কেমন- এ সকল বিষয়ে কি রাষ্ট্রের কোন দায়িত্ব নেই?

আমার বা আপনার ঘরে যে ছোট্ট শিশুটি আছে, তার মানসিক অবস্থার কথা একবার ভাবুনতো। যে শিশুটি শৈশবের আনন্দে সারাক্ষণ ছুটে বেড়ানোর কথা, খেলার মাঠে ব্যস্ত থাকার কথা, সে এখন ঘরবন্দী! গত ১৭ ই মার্চ জাতীয় শিশু দিবস উদযাপনের সময় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শিশুদের উদ্দেশ্যে একটি প্রাণছোয়া চিঠি লিখেন। কিন্তু বর্তমানে এই করোনার মহামারিতে রাষ্ট্রের আলাদা কোন পদক্ষেপ নেই কেন এই কোমলতি শিশুদের জন্য?

আমাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিন শেষ হয় গত ৪ এপ্রিল। একদিকে এটি যেমন আনন্দের, অন্যদিকে আতংকের, বিষন্নতার। আমার প্রতিবেশি, সহকর্মী, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজনের কাছে আসায় এবং আমার পরিবারের গ্রহণযোগ্যতার বিষয় নিয়ে সামাজিকভাবে আমাকে অন্যদের থেকে পৃথক করা হয়েছে, ঠিক সেইভাবে আমাকে আগের মতো সমাজের একজন সাধারণ ব্যক্তি হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করার কোন ব্যবস্থা এখনো চোখে পড়েনি। সর্বোচ্চ শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে বাস করে আসার যে অভিজ্ঞতা হয়েছে- তাতে আমি আশার আলো দেখতে পাচ্ছি না।

করোনা আমাকে নতুন করে ‘মানবাধিকার’ ও ‘গণতন্ত্র’ শব্দের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো। শুধু বিদেশ ফেরতরা নয়, অন্যারাও লকডাউনের কারণে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলছেন। বাংলাদেশে খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। সেই সকল মানুষের প্রতি রাষ্ট্র কী দায়িত্ব পালন করছে? কোথায় আজ সেই সকল প্রতিষ্ঠান, যারা মানবাধিকার বলে দিনের পর দিন বুলি আওড়াতেন? পুলিশ যেখানে জনগণের রক্ষক, সেখানে আজকে তারা খেটে খাওয়া মানুষদের উপর অপেশাদারমূলক আচরণ করছে। কী অপরাধ ছিলো তাদের? রাষ্ট্র থেকে খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য বরাদ্দের কতটুকু তারা পাচ্ছে? বলতে খুবই লজ্জা লাগে যে, দেশের এই দুর্যোগকালীন সময়ে কিছু মধ্যস্বত্ত্বভগীরা গরীবের হক মেরে খাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমের মারফত জানতে পারলাম, জনপ্রতিনিধিসহ ‘চাল চোর’ নামক ক্ষমতাসীন দলের প্রায় দুই শতকেরও উপর নেতা-কর্মী আটক হয়েছেন। কিন্তু সরকার যদি সঠিকভাবে তদারকির মাধ্যমে তা জনগণের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে দিতো, তবে সাধারণ জনগণকে ঘরের বাইরে বের হওয়ার প্রয়োজন হতো না। বিভিন্ন ধরণের হয়রানি ও নির্যাতনেরও শিকার হতে হতো না।

স্বাস্থ্যক্ষেত্রের কথা উল্লেখ না করলেই নয়, এক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। প্রতিদিন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে পিপিই’র বিষয়টি। অথচ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রথম এবং প্রধান যে বিষয়টি নিশ্চিত থাকার কথা, তা উল্লেখযোগ্য হারে নেই। আজ স্বাস্থ্যকর্মীরা তাদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেবা দিচ্ছে। ফলে তাদের ক্ষেত্রেও সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। পিপিই যে প্রত্যেক চিকিৎসক ও নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের একটি ‘অধিকার’ সেটিই বোধ হয় রাষ্ট্র বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অজানা!

আমি বিদেশ ফেরত ব্যক্তি এবং আমাকে কিভাবে কোয়ারেন্টাইন মেনে চলতে হবে, পাশাপাশি তা মেনে চলার জন্য রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা পেতে হবে। সাদামাটা ভাষায় বলতে গেলে- আমার নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিশেষ করে খাদ্য সামগ্রী কিভাবে আসবে, যদি আমি বাড়ির বাইরে যেতে না পারি?

সংবিধানে মৌলিক অধিকারের মধ্যে freedom of movement, right to life and personal liberty এর কথা উল্লেখ থাকলেও বর্তমান সময়ে একজন নাগরিকের কোয়ারেন্টাইন চলাকালীন সময়ে তা কতটুকু প্রয়োগ হচ্ছে?

এমনকি জাতিসংঘ ঘোষিত ICCPR, ICESCR ও CRC সনদে বাংলাদেশে স্বাক্ষর করেছে। এই সনদের নিয়মাবলীসমূহ কতটুকু কার্যকর রয়েছে সেটিও বড় প্রশ্ন।

সবশেষে আমার এতটুকু প্রত্যশা যে, এই দুর্যোগকালীন সময়ে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করবে এবং জনগণের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধাসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করবে। তবেই সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।

করিমা বেগম
সহকারী অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।

Comments

comments